ভূমিকা:
একটি আদর্শ সমাজ গঠন করা মানুষের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য, যেখানে ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত থাকে। সমাজের এই কাঠামো দাঁড় করাতে তরুণ ও যুবসমাজের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ তারা সমাজের সেই শক্তি, যারা নতুন চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবন এবং পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে। ইতিহাস সাক্ষী, যুগে যুগে তরুণরা ন্যায়বিচার ও আদর্শের জন্য লড়াই করে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তরুণরাই আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখে সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
এই আলোচনায় আদর্শ সমাজ গঠনে তরুণ ও যুবসমাজের ভূমিকা কুরআন, হাদীসে ও ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার আলোকে বিশ্লেষণ করা হবে।
ক. তরুণ ও যুবক বয়সের গুরুত্ব:
কুরআন ও হাদীসে তরুণ ও যুবক বয়সের অনেক গুরুত্ব ও তাৎপর্য উল্লেখ করা হয়েছে। এই ব্যাপারে কতিপয় কিছু তাৎপর্য উল্লেখ করা হলো-
১. আল্লাহর আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয় পাবে একদল যুবক:
হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَدْلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে দিন আল্লাহর (আরশের) ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না সে দিন আল্লাহ তা‘আলা সাত প্রকার মানুষকে সে ছায়ায় আশ্রয় দিবেন।
(১) ন্যায়পরায়ণ শাসক।
(২) যে যুবক আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে জীবন কাটায়।
(৩) যার অন্তরের সম্পর্ক সর্বদা মসজিদের সাথে থাকে।
(৪) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে যে দু’ব্যক্তি পরস্পর মহববত রাখে, উভয়ে একত্রিত হয় সেই মহববতের উপর আর পৃথক হয় সেই মহববতের উপর।
(৫) এমন ব্যক্তি যাকে সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী (অবৈধ মিলনের জন্য) আহবান জানিয়েছে। তখন সে বলেছে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।
(৬) যে ব্যক্তি গোপনে এমনভাবে সাদাকা করে যে, তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে না।
(৭) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তাতে আল্লাহর ভয়ে তার চোখ হতে অশ্রু বের হয়ে পড়ে (বুখারি: ১৪২৩)।
২. বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে যৌবনকালকে গনিমত মনে করা:
হাদীসে রাসূল সা. পাঁচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসকে গনিমত তথা সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করো। তন্মধ্যে অন্যতম হলো বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে যৌবনকালকে শ্রেষ্ঠ সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাও।
عَن ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنهُمَا قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ – صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – لِرَجُلٍ وَهُوَ يَعِظُهُ اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ
ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, পাঁচটি বস্তুকে পাঁচটির পূর্বে গনীমত জেনে মূল্যায়ন করো; বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে তোমার সুস্থতাকে, দারিদ্রের পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে, ব্যস্ততার পূর্বে তোমার অবসরকে এবং মরণের পূর্বে তোমার জীবনকে (বায়হাকি: ১০২৪৮)।
৩. শেষ বিচারের দিনও যৌবল কাল সম্পর্কে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসা করা হবে:
হাদীসে এসেছে-
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ: عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ شَبَابِهِ فِيمَا أَبْلَاهُ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَا أَنْفَقَهُ وَمَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ؟
ইবনু মাসউদ (রাঃ) নাবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন : কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের পদদ্বয় একটু নড়তে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। ১. তার বয়স সম্পর্কে, সে তা কী কাজে ব্যয় করেছে? ২. তার যৌবন সম্পর্কে, সে তা কী কাজে ক্ষয় করেছে? ৩. তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে, সে তা কোথা হতে অর্জন করেছে? ৪. আর তা কোথায় ব্যয় করেছে? এবং ৫. যে জ্ঞানার্জন করেছিল, সে অনুযায়ী কী ’আমাল করেছে? (তিরমিজি: ২৪১৬)
৪. কবির ভাষায়:
ضَيْفٌ زَارَنَا أَقَامَ عِنْدَنَا قَلِيْلًا .. .. سَوَّدَ الصُّحُفَ بِالذُّنْوْبِ وَوَلَّى
অর্থ: “যৌবন হল, একজন মেহমান যে আমাদের আঙ্গিনায় এসে কিছু সময় অবস্থান করল, তারপর সে গুনাহ দ্বারা আমলনামাকে কালো করল, অতঃপর পালিয়ে গেল”।
খ. আদর্শ সমাজ গঠনে যুগে যুগে তরুণ ও যুবক বয়সী মানুষদের ত্যাগ ও অবদান:
১. শিরকের বিরুদ্ধে তরুণ ইব্রাহিম (আ) এর একক লড়াই:
নমরুদ যখন নিজেই নিজেকে প্রভু দাবি করল, তখন মন্ত্রীসভার সদস্য ’আজরের সন্তান তরুণ ইব্রাহিম আ. একাই গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের শিরক ও কুফুরির বিরুদ্ধে নেমে গেলেন। রাষ্ট্রের প্রধান মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন। পবিত্র কুরআনে হযরত ইব্রাহিম আ. এর পরিচয় এভাবেই দেওয়া হচ্ছে-
فَجَعَلَهُمۡ جُذٰذًا اِلَّا كَبِیۡرًا لَّهُمۡ لَعَلَّهُمۡ اِلَیۡهِ یَرۡجِعُوۡنَ –قَالُوۡا مَنۡ فَعَلَ هٰذَا بِاٰلِهَتِنَاۤ اِنَّهٗ لَمِنَ الظّٰلِمِیۡنَ، قالُوۡا سَمِعۡنَا فَتًی یَّذۡكُرُهُمۡ یُقَالُ لَهٗۤ اِبۡرٰهِیۡمُ
অর্থ: অতঃপর সে মূর্তিগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল তাদের বড়টি ছাড়া, যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। তারা বলল, ‘আমাদের দেবদেবীগুলোর সাথে কে এমনটি করল? নিশ্চয় সে যালিম’। তাদের কেউ কেউ বলল, ‘আমরা শুনেছি এক যুবক এই মূর্তিগুলোর সমালোচনা করে। তাকে বলা হয় ইবরাহীম’ (আন্বিয়া: ৫৮- ৬০)।
২. যৌবনে মূসা আ. এর দেশত্যাগ:
তৎকালীন ফিরআউনের শাসনামলে বনী ইসরাঈলের লোকেরা ফিরআউনের গোষ্ঠী কিবতীদের দ্বারা নির্যাতিত ছিল। যদিও আল্লাহর বিশেষ কুদরত ও কৌশলে বনী ইসরাঈলকে উদ্ধারকারী নবী হযরত মূসা. স্বয়ং ফিরআউনের ঘরেই বড় হয়েছেন। কিন্তু হযরত মূসা বড় হয়ে তার গোত্রের অসহায়ত্ব ও কিবতীদের নির্যাতন বুঝতে শুরু করলেন। তিনি পরিকল্পনা করতে লাগলেন কিভাবে তার গোত্র বনী ইসরাঈলকে ফিরআউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু এর মধ্যেই আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত মূসা আ. কিবতী ও বনী ইসলাঈলের দুই ব্যক্তির মধ্যকার ঝগড়াকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রযন্ত্রের শাস্তি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে দেশত্যাগে বাধ্য হোন। প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর অন্য আরেকজন নবীর সান্যিধ্যে থেকে হযরত মূসা নবুয়্যতের দায়িত্ব লাভের উপযোক্ত হোন। অতপর আল্লাহর ইশারায় তিনি আবার তার গোত্রের মাঝে ফিরে আসেন এবং পথিমধ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়্যতের দায়িত্ব পেয়ে রাষ্ট্রের মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সরাসরি রাজ দরবারে ফেরআউনের মিথ্যা প্রভুত্বকে প্রশ্ন করে মহান রবের একাত্ববাদ উপস্থাপন করেন। অতপর মূসা আ. ও ফিরআউনের মাঝে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর অবশেষে আল্লাহ ফিরআউন ও তার বাহিনীকে সাগরে ডুবিয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেন। (সূরা কাসাস: ১- ৪০ আয়াতসমূহের আলোকে)
৩. দ্বীনের উপর অটল থাকার জন্য আসহাবুল কাহাফ তথা গুহাবাসী যুবকদের ত্যাগ:
তাওহীদের বিশ্বাসে অটল থাকার জন্য কয়েকজন যুবক দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে যাদেরকে ’আসহাবুল কাহফ’ নামে অবহিত করা হয়। এই গুহাবাসীরা ছিল একদল যুবক। ঐতিহাসিক বর্ণনামতে এই ঘটনা ছিল ২০০- ২৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। তবে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। এই যুবকদলের ত্যাগ ও ইখলাসকে আল্লাহর দরবারে এতটাই পছন্দ হয়েছে তিনি পবিত্র কুরআনে ”কাহাফ” নামে একটি সূরাই অবতীর্ণ করেছেন; যেন যুগ যুগ ধরে সত্যের পথে লড়াকু সৈনিকরা তাদের থেকে শিক্ষা নিতে পারে- সত্য থেকে কখনোই বিচ্যুত হওয়া যাবেনা। পবিত্র কুরআনে এই যুবকদলের পরিচয় দিতে উল্লেখ করেছেন-
اِذۡ اَوَی الۡفِتۡیَۃُ اِلَی الۡكَهۡفِ فَقَالُوۡا رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنۡ لَّدُنۡكَ رَحۡمَۃً وَّ هَیِّیٴۡ لَنَا مِنۡ اَمۡرِنَا رَشَدً
(স্মরণ কর) একদল যুবক যখন গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করল তখন তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তোমার নিকট হতে আমাদেরকে রহমত দান কর আর আমাদের ব্যাপারটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন কর (কাহফ: ১০)।’
৪. মুহাম্মদ সা. এর তরুণ বয়সে হিলফুল ফুজুল সংগঠন প্রতিষ্ঠা:
ফিযার যুদ্ধের পর ৫৮৭ খ্রি. সালে ১৭ বছর বয়সে এই সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন তরুণ মুহাম্মাদ সা.। হযরত আবু বকরও এই সংঘের সদস্য ছিলেন। এটি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম শান্তি সংঘ। এই সংঘ পবিত্র মক্কায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মাদ সা. ইসলাম পূর্বযুগে এই সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের কাজ ছিল পীড়িতদের সাহায্যদান, দুস্থদের আশ্রয়দান এবং অসহায়দের সহায়তা করা। বিদেশি ব্যবসায়ীদের জান মালের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া ইত্যাদি। এ সংগঠনের প্রভাবে মক্কা অনেক বিপর্যয় থেকে রেহাই পায়। কাবা ঘরের কালোপাথর পুনঃস্থাপনেও এই সংঘটি ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া হিলফুল ফুজুল মক্কাবাসীদের অনেক বিপর্যয় ঝামেলা ইত্যাদি আরো নানা সমস্যা থেকে সমগ্র মক্কাবাসীকে রক্ষা করেছিল।
৫. ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে তরুণ ও যুবকদের মাধ্যমে:
রাসূল সা. এর সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম তরুণ ও যুবকদের নেতৃত্বেই সম্পাদিত হয়েছে। নিচে প্রসিদ্ধ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হলো।
– যুবক হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যে শুরু হয়:
নবুয়তের ৬ষ্ঠ বর্ষের শেষ দিকে যিলহজ্জ মাসের কোন একদিনে হামযা (রাঃ)-এর ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিনদিন পরেই আরব জাহানের অন্যতম তেজস্বী পুরুষ, ৩২ বছর বয়সী যুবক ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) আকস্মিকভাবে মুসলিম হয়ে যান। তিনি ছিলেন চল্লিশতম মুসলিম। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিশেষ দো‘আর বরকত। হাদীছে এসেছে, ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) দো‘আ করেছিলেন,
اللَّهُمَّ أَعِزَّ الإِسْلاَمَ بِأَبِى جَهْلِ بْنِ هِشَامٍ أَوْ بِعُمَرَ
‘হে আল্লাহ! আবু জাহল ইবনু হিশাম অথবা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব দ্বারা তুমি ইসলামকে শক্তিশালী কর’। এই দো‘আর পরদিন ওমর ভোরে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং কা‘বা গৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করলেন (মিশকাত: ৬০৪৫)।
ছাফা পাহাড়ের পাদদেশের গৃহে যখন ওমর ইসলাম কবুল করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) ও গৃহবাসীগণ এমন জোরে তাকবীর ধ্বনী করলেন যে, মসজিদুল হারাম পর্যন্ত তা পৌঁছে গিয়েছিল। (আর রাহীকুল মাখতূম, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০৪)
ইসলাম কবুলের পরপরই ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করলেন এবং তার দরজায় করাঘাত করলেন। তখন আবু জাহল বের হয়ে এসে বলল, أَهْلًا وَ سَهْلًا مَا جَاءَ بِكَ؟ ‘স্বাগতম, তোমার আসার কারণ কী? ওমর (রাঃ) কোন ভূমিকা না দিয়ে তার মুখের উপর বলে দিলেন যে, ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী‘আত এনেছেন তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনে আবু জাহল তাকে গালি দিয়ে বলে উঠল, ‘আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ তার মন্দ করুন’। অতঃপর সে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে গেল। এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে লোক জমা হয়ে সকলেই ওমরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট চলল প্রায় দুপুর পর্যন্ত। এ সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যদি আমরা সংখ্যায় তিনশ’ পুরুষ হতাম, তবে দেখাতাম এরপর মক্কায় তোমরা থাকতে না আমরা থাকতাম’। এই ঘটনার পর নেতারা হত্যা করার উদ্দেশ্যে ওমরের বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। তিনি ঘরের মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু ‘আছ ইবনু ওয়ায়েল সাহমীর প্রচেষ্টায় লোকজন সেখান থেকে ফিরে গেলে ওমর (রা.) রাসূলের খিদমতে হাযির হয়ে বললেন,
يَا رَسُوْلَ اللهِ أَلَسْنَا عَلَى الْحَقِّ إِنْ مِتْنَا وَإِنْ حَيِيْنَا قَالَ بَلَى وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ إِنَّكُمْ عَلَى الْحَقِّ وَإِنْ مِتُّمْ وإِنْ حَيِيْتُمْ قَالَ قُلْتُ فَفِيْمَ الْاِخْتِفَاءُ وَالَّذِيْ بَعَثَكَ بِاْلحَقِّ لَنَخْرُجَنَّ.
‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমরা কি হক্বের উপরে নই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয় তোমরা সত্যের উপর আছ, যদি তোমরা মৃত্যুবরণ কর কিংবা জীবিত থাক। ওমর (রাঃ) বললেন, তাহলে লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন কী! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন তাঁর কসম করে বলছি, অবশ্যই আমরা প্রকাশ্যে বের হব’। অতঃপর রাসূলকে মাঝখানে রেখে দুই সারির মাথায় ওমর ও হামযার নেতৃত্বে মুসলিমগণ প্রকাশ্যে মিছিল সহকারে মসজিদুল হারামে উপস্থিত হলেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এদিনই ওমর (রাঃ)-কে ফারূক (الفاروق) বা ‘হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَا زِلْنَا أَعِزَّةً مُنْذُ أَسْلَمَ عُمَرُ
‘উমার (রাঃ) যেদিন থেকে ইসলাম গ্রহণ করলেন ঐ দিন হতে আমরা সর্বদা সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত আছি (বুখারি: ৩৮৬৩)। ছুহায়েব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) বলেন, ‘ওমর (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পর ইসলাম তার গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে বাইরের জগতে প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। মানুষকে ইসলামের দিকে প্রকাশ্যে আহক্ষান জানানো সম্ভব হয়। আমরা গোলাকার হয়ে কা‘বা গৃহের পাশে বসতে পারতাম এবং ত্বাওয়াফ করতে পারতাম। যারা আমাদের উপর কঠোরতা দেখায় তাদের প্রতিশোধ নিতাম এবং তাদের কোন কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতাম’। (আর-রাহিকুল মাখতুম: পৃ. ১০৫)
– তিন সেনাপতির শাহাদাতের পর তরুণ সেনা খালিদ রা. এর নেতৃত্বে জয়লাভ:
মুতার যুদ্ধে তিনজন সেনাপতি একের পর এক শহীদ হয়, অতপর মুসলিম বাহিনী যখন নেতাশূন্য তখন নেতৃত্বের পতাকা হাতে নেন তরুণ সেনা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ। যাকে আল্লাহর রাসূল স্বয়ং আল্লাহর তরবারী হিসেবে উপাধী দিয়েছিলেন। খালিদের হাতে যুদ্ধের নেতৃত্ব আসতেই পরিস্থিতি মুসলিমদের পক্ষে চলে আসে এবং মুসলিমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ خَطَبَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ” أَخَذَ الرَّايَةَ زَيْدٌ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَهَا جَعْفَرٌ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَهَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيبَ، ثُمَّ أَخَذَهَا خَالِدُ بْنُ الْوَلِيدِ عَنْ غَيْرِ إِمْرَةٍ، وفي روية: حَتَّى أَخَذَ الرَّايَةَ سَيْفٌ مِنْ سُيُوفِ اللَّهِ، فَفُتِحَ لَهُ ـ وَقَالَ ـ مَا يَسُرُّنَا أَنَّهُمْ عِنْدَنَا ”. قَالَ أَيُّوبُ أَوْ قَالَ ” مَا يَسُرُّهُمْ أَنَّهُمْ عِنْدَنَا ”. وَعَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ.
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (মুতার যুদ্ধে সৈন্য প্রেরণের পর) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবা দিতে গিয়ে বলেন, যায়দ (রাঃ) পতাকা ধারন করল এবং শহীদ হল, তারপর জাফর (রাঃ) পতাকা ধারন করল, সেও শহীদ হল। তারপর আবদুল্লাহ ইবনু রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা ধারন করল এবং সেও শহীদ হল। এরপর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) বিনা নির্দেশেই পতাকা ধারণ করল। অন্যবর্ণনায় আছে- অবশেষে সাইফুল্লাহ্দের মধ্যে এক সাইফুল্লাহ (আল্লাহর তরবারি) হাতে পতাকা ধারণ করেছে। অতপর সে বিজয় লাভ করল। তিনি আরও বলেন, তারা আমাদের মাঝে জীবিত থাকুক তা তাদের নিকট আদৌ আনন্দদায়ক না, এ সময়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল। (বুখারি: ২৬০৫, ৩৯৩৬)
– তরুণ সাহাবী হযরত আলী রা. এর হাতে খায়বার যুদ্ধের বিজয়:
খায়বার যুদ্ধের সময় একের পর এক ইয়াহুদীদের দুর্গগুলো বিজয় করা হচ্ছিল। কিন্তু সর্বশেষ কামূস দুর্গ কোনভাবেই জয় করা যাচ্ছিলনা। প্রায় উনিশ দিন অবরোধের পর রাসূল সা. ঘোষণা দেন আগামীকাল এমন এক ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব দেওয়া হবে তার হাতেই এই দুর্গ বিজয় হবে। হবুখারির হাদীসে এসেছে-
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْد ٍ ـ رضى الله عنه ـ سَمِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ يَوْمَ خَيْبَرَ ” لأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ رَجُلاً يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَى يَدَيْهِ ”. فَقَامُوا يَرْجُونَ لِذَلِكَ أَيُّهُمْ يُعْطَى، فَغَدَوْا وَكُلُّهُمْ يَرْجُو أَنْ يُعْطَى فَقَالَ ” أَيْنَ عَلِيٌّ ”. فَقِيلَ يَشْتَكِي عَيْنَيْهِ، فَأَمَرَ فَدُعِيَ لَهُ، فَبَصَقَ فِي عَيْنَيْهِ، فَبَرَأَ مَكَانَهُ حَتَّى كَأَنَّهُ لَمْ يَكُنْ بِهِ شَىْءٌ فَقَالَ نُقَاتِلُهُمْ حَتَّى يَكُونُوا مِثْلَنَا. فَقَالَ ” عَلَى رِسْلِكَ حَتَّى تَنْزِلَ بِسَاحَتِهِمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الإِسْلاَمِ، وَأَخْبِرْهُمْ بِمَا يَجِبُ عَلَيْهِمْ، فَوَاللَّهِ لأَنْ يُهْدَى بِكَ رَجُلٌ وَاحِدٌ خَيْرٌ لَكَ مِنْ حُمْرِ النَّعَمِ ”. وفي رواية: قَالَ كَانَ عَلِيٌّ ـ رضى الله عنه ـ تَخَلَّفَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي خَيْبَرَ، وَكَانَ بِهِ رَمَدٌ، فَقَالَ أَنَا أَتَخَلَّفُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَخَرَجَ عَلِيٌّ فَلَحِقَ بِالنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، فَلَمَّا كَانَ مَسَاءُ اللَّيْلَةِ الَّتِي فَتَحَهَا فِي صَبَاحِهَا، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ لأُعْطِيَنَّ الرَّايَةَ ـ أَوْ قَالَ لَيَأْخُذَنَّ ـ غَدًا رَجُلٌ يُحِبُّهُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ ـ أَوْ قَالَ يُحِبُّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ـ يَفْتَحُ اللَّهُ عَلَيْهِ ”. فَإِذَا نَحْنُ بِعَلِيٍّ، وَمَا نَرْجُوهُ، فَقَالُوا هَذَا عَلِيٌّ، فَأَعْطَاهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم، فَفَتَحَ اللَّهُ عَلَيْهِ.
সাহল ইবনু সা’আদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি খায়বারের যুদ্ধের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন, আমি এমন এক ব্যাক্তিকে পতাকা দিব যার হাতে বিজয় অর্জিত হবে। এরপর কাকে পতাকা দেয়া হবে, সেজন্য সকলেই আশা করতে লাগলেন। পরদিন সকালে প্রত্যেকেই এ আশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন যে, হয়ত তাকে পতাকা দেয়া হবে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আলী কোথায়? তাঁকে জানানো হল যে, তিনি চক্ষু রোগে আক্রান্ত। তখন তিনি আলীকে ডেকে আনতে বললেন। তাকে ডেকে আনা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মুখের লালা তাঁর উভয় চোখে লাগিয়ে দিলেন। তৎক্ষনাৎ তিনি এমনভাবে সুস্থ হয়ে গেলেন যে, তাঁর কোন অসুখই ছিল না। তখন আলী (রাঃ) বললেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে ততক্ষণ লড়াই চালিয়ে যাব, যতক্ষণ না তারা আমাদের মত হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সোজা এগিয়ে যাও। তুমি তাদের প্রান্তরে উপস্থিত হলে প্রথমে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান কর এবং তাদের করণীয় সম্বন্ধে তাদের অবহিত কর। আল্লাহর কসম, যদি একটি লোকও তোমার দ্বারা হিদায়াত প্রাপ্ত হয়, তবে তা তোমার জন্য লাল রংয়ের উটের চাইতেও শ্রেয়। অন্যবর্ণনায় আছে- খায়বার যুদ্ধে আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পেছনে থেকে যান, (কারণ) তাঁর চোখে অসুখ হয়েছিল। তখন তিনি বললেন, আমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পিছিয়ে থাকব? এরপর আলী (রাঃ) বেরিয়ে পড়লেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে এসে মিলিত হলেন। যখন সে রাত এল, যে রাত শেষে সকালে আলী (রাঃ) খায়বার জয় করেছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগামীকাল আমি এমন এক ব্যাক্তিকে পতাকা অর্পণ করব, কিংবা (বলেন) আগামীকাল এমন এক ব্যাক্তি পতাকা গ্রহণ করবে যাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল ভালবাসেন। অথবা তিনি বলেছিলেন, যে আল্লাহ্ তাআলা ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে। আল্লাহ্ তাআলা তারই হাতে খায়বার বিজয় দান করবেন। হঠাৎ আমরা দেখতে পেলাম যে, আলী (রাঃ) এসে উপস্থিত, অথচ তাঁর আগমন প্রত্যাশা করিনি। তারা বললেন, এই যে আলী (রাঃ) এসে গিয়েছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে পতাকা অর্পণ করলেন। আর আল্লাহ্ তাআলা তাঁরই হাতে খায়বারের বিজয় দান করলেন। (বুখারি: ২৭৪০, ২৭৬৭)
এরূপ অসংখ্য অসংখ্য অভিযান ও দূরহ কাজ আল্লাহর রাসূল তরুণ সাহাবীদের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। আর এই তরুণ-যুবকরাই পরবর্তীতে রাসূল সা. এর রেখে যাওয়া দ্বীন ইসলামের ঝান্ডাকে ধারাবাহিকভাবে শক্ত হাতে ধারণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা তারাই মানবজাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। তাদের ইতিহাসকে বলা হয় যুগের সোনালী অধ্যায়।
৬. মুসলমানদের সর্বশেষ সম্রাজ্য উসমানীয় সাম্রাজ্য ব্যপকতা লাভ করে এক তরুণ তুর্কীর হাতে:
উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রাথমিক বিকাশের ক্ষেত্রে তরুণ সুলতানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তরুণ সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২১ বছর বয়সে কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেছিলেন, যা তৎকালীন বিশ্বের মানচিত্রে বিশাল পরিবর্তন ঘটায় এবং ইসলামী সাম্রাজ্যকে আরো প্রসারিত করে। মূলত বিশিষ্ট সাহাবি মুয়াবিয়া ইবনে সুফিয়ান রা. এর যুগ থেকে অনেকেই কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেউই সফল হতে পারেননি। প্রত্যেক মুসলিম সেনাপতিই আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কারণ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ীর ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর রাসুল প্রশংসা করে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা (মুসলিমরা) অবশ্যই কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। কতোই না অপূর্ব হবে সেই বিজয়ী সেনাপতি, কতোই না অপূর্ব হবে তার সেনাবাহিনী।’ (আহমাদ আল-মুসনাদ ১৪ : ১৩১)।
৭. তরুণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সফল ভারত অভিযানের ফলে উপমহাদেশে প্রথম ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছে:
খোলাফায়ে রাশেদিনের সময় থেকেই ইসলামের দাওয়াত ভারত অঞ্চলে পৌঁছলেও ইসলামের রাজনৈতিক বিজয় শুরু হয়েছে হিজরির দ্বিতীয় শতক থেকে। ইসলামের অনেক মুজাহিদ ভারত অভিযান করলেও টেকসই ও সফলভাবে কেউই সম্পন্ন করতে পারেনি। মুহাম্মদ বিন কাসিম গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে ছয় হাজার সিরীয় ও ইরাকি যোদ্ধা, ছয় হাজার উষ্ট্রারোহী এবং তিন হাজার ভারবাহী পশুর সমন্বয়ে গঠিত সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে সিন্ধুর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। রায় ও শিরাজ হয়ে তিনি মেকরানে উপস্থিত হন। মেকরানের শাসক মুহাম্মদ হারুন তাঁকে প্রয়োজনীয় রসদ, অস্ত্রাদি ও দুর্গ ধ্বংসকারী যন্ত্রাদি সরবরাহ করেন। এ সময় সিন্ধুর রাজা দাহিরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জাঠ ও মেঠ সৈন্যরা মুসলিম বাহিনীতে যোগ দেয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে প্রথমে দাহিরের সমুদ্রবন্দর দেবাল জয় করেন। দেবাল সমুদ্রবন্দর পদানত করার পর মুসলিম বাহিনী দেবাল দুর্গ অবরোধ করে এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। ৭১২ হিজরির ১২ জুন ঐতিহাসিক এ বিজয় অর্জিত হয়। তারপর সিন্ধু ইসলামি খিলাফতের অংশ হয়।
৮. সম্প্রতি বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের মূল কারিগর ছিল আমাদের তরুণ সমাজ:
সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটি গণঅভ্যুত্থান ও গণবিপ্লবের মাধ্যমে ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট ও জালিম শাসক উৎখাত হয়েছে। উক্ত বিপ্লবের মূল কারিগর ছিল দেশের তরুণ সমাজ।
উপরোক্ত প্রসিদ্ধ ঘটনাবলী প্রমাণ করে যুগে যুগে দেশ, জাতি ও সমাজ যখনই বিপদের সম্মুখিন হয়েছে তখন তরুণ ও যুব সমাজের হাত ধরেই মানবজাতি সঠিক দিশা পেয়েছে।
আদর্শ সমাজ গঠনে তরুণ ও যুবকদের করণীয়
যুগে যুগে তরুণ ও যুবকদের ত্যাগ ও নানা অবদানের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান তরুণ সমাজের কিছু করণীয় দিক রয়েছে; যেগুলো তরুণ ও যুবকরা বাস্তবায়ন করতে পারলে আমাদের সমাজ সুন্দর হবে। নিচে তরুণ ও যুবকদের কিছু করণীয় দিক তুলে ধরা হলো-
১. সুন্দর চরিত্র গঠনে সচেষ্ট হওয়া:
যে সমাজ বা দেশে যুবসমাজের চরিত্র ভালো থাকবে, সে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন ঠিক থাকবে। আর যে সমাজে যুবকদের চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেবে, সে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন ঠিক থাকবে না এবং সে সমাজের পতন ও ধ্বংস অনিবার্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তারা, যারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ (জামিউস সগির: ২১৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সুন্দর চরিত্র গঠনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করতেন,
اللهمَّ كَمَا حَسَّنتَ خَلْقي فحَسِّنْ خُلُقي
‘হে আল্লাহ! আমার চরিত্রকে সুন্দর করুন, যেমনিভাবে আপনি আমার শারীরিক গঠনকে সুন্দর করেছেন।’(মুসনাদে আহমদ : ৩৮২৩)
সুন্দর চরিত্র গঠনে করণীয়:
ক. মাদক পরিহার: মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা ও সক্রিয়তা নষ্ট হয়ে যায়। নানা অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। স্নায়ুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় মানবজীবনকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এ জন্য মাদক গ্রহণকে ইসলামে বড় অপরাধ তথা হারাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন,
كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ
‘প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই মাদক। আর প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই হারাম।’ (মুসলিম: ২০০৩)
খ. পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের হেফাজত: পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়াকে উপলব্ধি করে। দুনিয়ায় যেমন কিছু বিষয় ভালো, তেমনি কিছু বিষয় মন্দ। তাই সুন্দর জীবন ও চরিত্র গঠনে জরুরি হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের উত্তম ব্যবহার এবং গর্হিত বিষয় থেকে তা হেফাজত করা। সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য নবীজি (সা.) দোয়া শিখিয়েছেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِي وَمِنْ شَرِّ بَصَرِي وَمِنْ شَرِّ لِسَانِي وَمِنْ شَرِّ قَلْبِي وَمِنْ شَرِّ مَنِيِّي
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় চাই—আমার শ্রবণশক্তির অনিষ্ট থেকে, দৃষ্টির অনিষ্ট থেকে, যবানের অনিষ্ট থেকে, অন্তরের অনিষ্ট থেকে এবং আমার আকাঙ্ক্ষার অনিষ্ট থেকে।’(সুনানে আবু দাউদ: ১৫৫১) অন্য হাদীসে এসেছে-
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ .
অর্থাৎ সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার দু’চোয়ালের মাঝের বস্তু (জিহ্বা) এবং দু’রানের মাঝখানের বস্তু (লজ্জাস্থান) এর জামানত আমাকে দিবে, আমি তার জান্নাতের যিম্মাদার হবো। (বুখারি: ৬৪৭৪)
গ. পশ্চিমা ও ভারতীয় অশ্লীল সংস্কৃতি প্রতিহত করা: মানুষ কৃষ্টি-কালচার-সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে নিজ আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। বর্তমানে মুসলিম যুবকদের নানাভাবে বিজাতীয়করণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পশ্চিমা ও ভারতীয় মুশরিকদের সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের যুবসমাজের নৈতিকতার অধপতন হচ্ছে। যুবসমাজের উচিত এসব শুধু পরিহার নয়, বরং প্রতিহত করে নিজেদের ও সমাজকে রক্ষা করা। বাংলাদেশের মুসলিমদের মনে ধারণা জন্মেছে যে, পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতীয় সহযোগিতা ছাড়া আমাদের বাঁচার উপায় নেই। এজন্য আমাদের সমাজকে ধ্বংসকারী তাদের সকল কু-প্রস্তাব আমরা মেনে নেই। অথচ আল্লাহ তা’আলা কুরআনে মুমিনদেরকে বলেন,
اَلشَّیۡطٰنُ یَعِدُكُمُ الۡفَقۡرَ وَ یَاۡمُرُكُمۡ بِالۡفَحۡشَآءِ ۚ وَ اللّٰهُ یَعِدُكُمۡ مَّغۡفِرَۃً مِّنۡهُ وَ فَضۡلًا ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের (অঢেল রিজিক) প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ (বাকারা: ২৬৮)।
২. জ্ঞানার্জন:
ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয়,
اِقۡرَاۡ بِاسۡمِ رَبِّكَ الَّذِیۡ خَلَقَ
অর্থাৎ পড়ো, তোমার পালনকর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা : আলাক, আয়াত : ১) দ্বীনি জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি পার্থিব জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জনও ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কাম্য। সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত, সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে তরুণ সমাজকে অবশ্যই সর্বমুখী পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।
৩. আল্লাহর আনুগত্য করা:
যৌবনে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে কাটানোর অনেক গুরুত্ব, আলাদা তৃপ্তি ও মূল্যায়ন রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণির ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তার নিজের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। এর মধ্যে একজন সেই যুবক, যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতে।’ (বুখারি: ১৪২৩)
৪. সর্বদা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা:
বর্তমানে যুবকদের বড় একটা অংশ বেকার ও হতাশার জীবন যাপন করছে। আল্লাহর ইবাদত-আনুগত্য ও তাঁর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা ছাড়া পার্থিব নানা উপায়-উপকরণের মাধ্যমে নিজেদের কাঙ্ক্ষিত ও উন্নত ক্যারিয়ার গড়তে যখন ব্যর্থ, তখন তাদের জীবনে নেমে আসে হতাশা ও অমানিশার অন্ধকার। ইসলাম তাদের এ অবস্থা থেকে উঠে এসে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা রাখা এবং তাঁর সাহায্য কামনার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
يَا غُلاَمُ إِنِّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ احْفَظِ اللَّهَ يَحْفَظْكَ احْفَظِ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوِ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوِ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلاَّ بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ رُفِعَتِ الأَقْلاَمُ وَجَفَّتِ الصُّحُفُ
অর্থ: হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি- তুমি আল্লাহ্ তা’আলার (বিধি-নিষেধের) রক্ষা করবে, আল্লাহ তা’আলা তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রাখবে, আল্লাহ্ তা’আলাকে তুমি কাছে পাবে। তোমার কোন কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তা’আলার নিকট চাও, আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহ্ তা’আলার নিকটেই কর। আর জেনে রাখো, যদি সকল উন্মাতও তোমার কোন উপকারের উদ্দেশে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা’আলা তোমার জন্যে লিখে রেখেছেন। অপরদিকে যদি সকল ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ্ তা’আলা তোমার তাকদিরে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে। (তিরমিজি: ২৫১৬)
৫. বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা:
একটি আদর্শ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক হবে অত্যন্ত মধুর। পারস্পরিক ভালবাসাপূর্ণ সম্পর্ক ছাড়া কখনোই আদর্শ সমাজের কল্পনা করা যায়না। এই ব্যাপারে রাসূল সা. বলেন,
والَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لاَ تَدْخُلُوا الجَنَّةَ حَتّٰـى تُؤْمِنُوا، وَلاَ تُؤْمِنُوا حَتّٰـى تَحَابُّوا أوَلاَ أدُلُّكُمْ عَلٰـى شَيْءٍ إِذَا فَعَلْتُمُوْهُ تَـحَابَبْتُمْ ؟ أفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ
সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে! তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না; যতক্ষণ না তোমরা মু’মিন হবে। এবং তোমরা মু’মিন হতে পারবে না; যে পর্যন্ত না তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসবে। আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ বলে দেব না, যখন তোমরা তা করবে, তখন তোমরা একে অপরকে ভালবাসতে লাগবে? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালাম প্রচার কর (মুসলিম: ২০৩)। অন্য একটি হাদীসে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে-
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا ، وَيُوَقِّرْ كَبِيْرَنَا
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করেনা এবং বড়দের সম্মান করেনা সে আমাদের দলভুক্ত নয় (সহিহুল জামে’: ৫৪৪৫)
৬. যে কোন অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করা ও ভাল কাজে সহায়তা করা:
আদর্শ সমাজ গঠনে তরুণদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা প্রয়োজন এক্ষেত্রে। যে কোন অন্যায় কাজে প্রকৃতপক্ষে বাধা প্রদান করার ক্ষমতা কেবল তরুণ ও যুবকদেরই থাকে। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানেই এই ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
كُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ
তোমরাই হলে সর্বোত্তম দল,যাদেরকে মানব সমাজের জন্য বাছাই করা হয়েছে। (তোমাদের প্রধান কাজ হলো) তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে (আল-ইমরান: ১১০)। অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা আরো স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
وَ تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡبِرِّ وَ التَّقۡوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوۡا عَلَی الۡاِثۡمِ وَ الۡعُدۡوَانِ
অর্থাৎ তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ায় পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না (মাইদা: ০২)। অন্যায়ের প্রতিবাদ সম্পর্কে রাসূল সা. বলেন,
“مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ”
“তোমাদের মধ্যে কেউ কোন অন্যায় দেখলে তা সে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করবে, যদি তা সম্ভব না হয় তবে মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে, তাও যদি না করতে পারে তাহলে অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করবে। আর এ হচ্ছে (অন্তর দিয়ে প্রতিহত করা) দুর্বলতম ঈমান (মুসলিম: ৪৯)।”
৭. দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত করা:
আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবন বিধান ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যুবসমাজের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমেই। ইসলামের প্রথম যুগে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যেসব সাহাবি তাঁর প্রতি ঈমান আনে, তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) হিদায়াতের যে আলোকবর্তিকা নিয়ে আসেন, তার অনুসরণ করে, তারা সবাই ছিল যুবক! ইসলামী দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অনেক সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের হাতেই ন্যস্ত করেন এবং তাদের হাতে দায়িত্ব সমর্পণ করেন। যেমন—উসামা ইবনু জায়েদ (রা.)-কে আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর মতো বড় সাহাবিদের উপস্থিতিতে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রাসুলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধের সেনাপতি নিয়োগ করেন। হুনাইনের যুদ্ধে যাওয়ার সময় উত্তাব ইবন উসাইদ (রা.)-কে মাত্র ২০ বছর বয়সে রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কার গভর্নর নিয়োগ করেন। এ ছাড়া ইসলামের ইতিহাসে ইসলামের ঝাণ্ডা বহন করা, ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত রাখা এবং ইসলামের আলোকে দুনিয়ার আনাচকানাচে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুবকদের ভূমিকার বিষয়ে আরো অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে; যা ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
উপসংহার:
কোনো কিছু প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণ ও যুবকরা যেমন বদ্ধপরিকর, তেমনি কোনো কিছু ভাঙনেও তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এদের শক্তি হচ্ছে এদের আত্মবিশ্বাস। এরা যৌবনের তেজে তেজোদ্দীপ্ত। তাই জাতীয় কল্যাণ প্রতিষ্ঠাও এদের কাছে অসম্ভব নয়। এদের দুর্দমনীয় শক্তিকে ন্যায়ের পথে চালিত করলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হওয়া যেমন মোটেই অসম্ভব নয়, তেমনি অন্যায়ের পথে পরিচালিত করলে অন্যায় প্রতিষ্ঠা হওয়াও মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তরুণ ও যুবশক্তিকে তাই ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধে কাজে লাগাতে হবে।
উপরোক্ত বয়ানের আরবী অনুবাদ (সংক্ষিপ্ত ও মূলবক্তব্য)
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ، أَمَّا بُعْدُ . . . . . . . . . . . . . . .
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ –
مَوْضُوعُنَا اليَوْمِ: دَوْرُ الشَّبَابِ فِي بِنَاءِ المُجْتَمَعِ المِثَالِيِّ
يَعُدُّ بِنَاءُ مُجْتَمَعٍ مِثَالِيٍّ هَدَفًا رَئِيسِيًّا فِي حَيَاةِ الإِنْسَانِ، حَيْثُ تَسُودُ العَدَالَةُ وَالأَخْلَاقُ وَالمُسَاوَاةُ وَالسَّلَامُ. يَلْعَبُ الشَّبَابُ دَوْرًا مَحْوَرِيًّا فِي تَحْقِيقِ هَذَا الهَدَفِ، فَهُمْ طَاقَةُ المُجْتَمَعِ الَّتِي يُمْكِنُهَا مِنْ خِلَالِ التَّفْكِيرِ الجَدِيدِ وَالابْتِكَارِ وَالتَّغْيِيرِ دَفْعُ المُجْتَمَعِ نَحْوَ التَّقَدُّمِ. عَلَى مَرِّ العُصُورِ، كَانَ الشَّبَابُ هُمُ القُوَّةَ الدَّافِعَةَ وَرَاءَ النِّضَالِ مِنْ أَجْلِ العَدَالَةِ، حَيْثُ قَامُوا بِإِحْدَاثِ تَغْيِيرَاتٍ ثَوْرِيَّةٍ فِي المُجْتَمَعَاتِ. وَتَارِيخِيًّا، اِعْتَمَدَ اللهُ عَلَى الشَّبَابِ لِتَغْيِيرِ المُجْتَمَعَاتِ نَحْوَ الأَفْضَلِ.
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ، الآنَ أُلْقِيْ أَمَامَكُمْ عَنْ أَهَمِّيَّةِ مَرْحَلَةِ الشَّبَابِ:
لَقَدْ تَمَّ التَّرْكِيزُ عَلَى أَهَمِّيَّةِ مَرْحَلَةِ الشَّبَابِ فِي القُرْآنِ الكَرِيمِ وَالحَدِيثِ الشَّرِيفِ، حَيْثُ ذُكِرَتْ العَدِيدُ مِنَ الفَضَائِلِ المُرْتَبِطَةِ بِهَذِهِ المَرْحَلَةِ. وَمِنْ ذَلِكَ:
أَوَّلًا: الشَّبَابُ الَّذِينَ يُظِلُّهُمُ اللهُ تَحْتَ ظِلِّ عَرْشِهِ: وَرَدَ فِي الحَدِيثِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ… (إِمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ)رَوَاهُ البُخَارِيُّ: 1423
ثَانِيًا: اغْتِنَامُ الشَّبَابِ قَبْلَ الشَّيْخُوخَةِ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ…(رَوَاهُ البُخَارِيُّ: 10248)
ثَالِثًا: سُؤَالٌ خَاصٌّ عَنِ الشَّبَابِ يَوْمَ القِيَامَةِ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تَزُولُ قَدَمَا ابْنِ آدَمَ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ خَمْسٍ: عَنْ عُمُرِهِ… وَعَنْ شَبَابِهِ… (رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ: 2416)
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ، الآنَ أُلْقِيْ أَمَامَكُمْ عَنْ دَوْرِ الشَّبَابِ فِي بِنَاءِ المُجْتَمَعِ المِثَالِيِّ: لِلشَّبَابِ دَوْرٌ كَبِيرٌ فِي بِنَاءِ المُجْتَمَعِ المِثَالِيِّ. وَيُمْكِنُ تَلْخِيصُ أَهَمِّ أَدْوَارِهِمْ فِيمَا يَلِي:
أَوَّلًا: الاهْتِمَامُ بِتَكْوِينِ الشَّخْصِيَّةِ السَّلِيمَةِ: يُعَدُّ بِنَاءُ شَخْصِيَّةِ الشَّبَابِ مِنْ أَعْظَمِ الأُسُسِ الَّتِي تَقُومُ عَلَيْهَا المُجْتَمَعَاتُ السَّلِيمَةُ. فَالمُجْتَمَعُ الَّذِي يَتَمَتَّعُ شَبَابُهُ بِحُسْنِ الخُلُقِ هُوَ مُجْتَمَعٌ يَتَمَتَّعُ بِالاسْتِقْرَارِ وَالسَّلَامِ. وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ أَحَبَّكُم إِلَى اللهِ أَحْسَنُكُم أَخْلَاقًا (رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ: 218)
ثَانيًا: تَجَنُّبُ المُخَدِّرَاتِ وَحِفَاظُ الحَوَاسِّ الخَمْسِ:
حَذَّرَ الإِسْلَامُ مِنَ المُخَدِّرَاتِ لِمَا لَهَا مِنْ أَضْرَارٍ عَلَى العَقْلِ وَالجِسْمِ، وَجَعَلَهَا مِنَ الكَبَائِرِ. قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ (رَوَاهُ مُسْلِمٌ: 2003) كَمَا أَنَّ حِفْظَ الحَوَاسِّ الخَمْسِ مِنَ الأُمُورِ الهَامَّةِ الَّتِي أَمَرَ بِهَا الإِسْلَامُ لِحِمَايَةِ النَّفْسِ مِنَ الانْحِرَافِ.
ثَالِثًا: مُوَاجَهَةُ الثَّقَافَةِ الفَاسِدَةِ: يَنْبَغِي لِلشَّبَابِ المُسْلِمِ التَّصَدِّي لِلثَّقَافَاتِ الفَاسِدَةِ الَّتِي تُؤَدِّي إِلَى تَدَهْوُرِ الأَخْلَاقِ. قَالَ اللهُ تَعَالَى: الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالفَحْشَاءِ (البَقَرَةُ: 268)
رَابِعًا: طَلَبُ العِلْمِ: حَثَّ الإِسْلَامُ عَلَى طَلَبِ العِلْمِ، وَقَدْ جَاءَ فِي أَوَّلِ وَحْيٍ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (العَلَقُ: 1)عَلَى الشَّبَابِ أَنْ يَطْلُبُوا العِلْمَ الدِّينِيَّ وَالدُّنْيَوِيَّ مِنْ أَجْلِ بِنَاءِ مُجْتَمَعٍ مُتَقَدِّمٍ وَمُزْدَهِرٍ.
خَامِسًا: طَاعَةُ اللهِ فِي فَتْرَةِ الشَّبَابِ: الشَّبَابُ الَّذِينَ يَقْضُونَ حَيَاتَهُم فِي طَاعَةِ اللهِ لَهُمْ مَكَانَةٌ خَاصَّةٌ. قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: شَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ (رَوَاهُ البُخَارِيُّ: 1423)
سَادِسًا: الاعْتِمَادُ عَلَى اللهِ وَالثِّقَةُ بِهِ: يَنْبَغِي لِلشَّبَابِ أَنْ يَثِقُوا بِاللهِ وَيَعْتَمِدُوا عَلَيْهِ فِي حَيَاتِهِم. قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ (رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ: 2516)
سَابِعًا: احْتِرَامُ الكِبَارِ وَالعَطْفُ عَلَى الصِّغَارِ: يُعَدُّ الاحْتِرَامُ المُتَبَادَلُ بَيْنَ أَفْرَادِ المُجْتَمَعِ مِنَ الأُسُسِ الَّتِي تَقُومُ عَلَيْهَا المُجْتَمَعُ المِثَالِيُّ. قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيُوَقِّرْ كَبِيرَنَا
(رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ: 5445)
وَفِي الخَاتِمَةِ: الشَّبَابُ هُمُ القُوَّةُ المُحَرِّكَةُ لِلْمُجْتَمَعِ، وَلَهُمْ القُدْرَةُ عَلَى النُّهُوضِ بِالمُجْتَمَعَاتِ نَحْوَ التَّقَدُّمِ أَوِ التَّرَاجُعِ. إِذَا تَمَّ تَوْجِيهُ طَاقَةِ الشَّبَابِ نَحْوَ الخَيْرِ وَالعَدْلِ، فَإِنَّ المُجْتَمَعَ سَيَنْهَضُ وَيَتَقَدَّمُ.
بَارَكَ اللَّهُ لِي وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيمِ، وَنَفَعَنِي وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيهِ مِنَ الْايَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ. أَقُولُ قَوْلِي هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الْجَلِيل، لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِينَ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرُوه أَنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
সংকলন, সম্পাদনা, পরিমার্জন ও আরবী তরজমা: ইমরান মাহমুদ (এম.ফিল, আরবী বিভাগ, ঢাবি) পুনর্মূল্যায়ন: মুফতি ইসমাঈল হোসাইন (খতিব ও দাঈ)