ভূমিকা:
ইসলামী শরিয়াহ হচ্ছে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কেবল ব্যক্তি নয়, বরং সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সর্বজনীন নীতিমালা প্রদান করে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। সংবিধানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত (ধারা ২-ক)। মুসলিম জনগণের একটি বড় অংশ ইসলামি আদর্শে পরিচালিত জীবনব্যবস্থা চায়। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে ইসলামী শরিয়াহর অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি এটি কতটা বাস্তবসম্মত এবং কী কী বাধা-বিপত্তি রয়েছে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। নিচে সবিস্তারে আলোচনা করা হলো।
১. ইসলামী শরিয়ার ধারণা ও গুরুত্ব:
ইসলামী শরিয়াহ শব্দটি এসেছে “শর‘আ” (شَرَعَ) শব্দমূল থেকে, যার অর্থ হলো পথনির্দেশ। এটি কেবল আইন নয়—বরং এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইবাদত, নৈতিকতা, পরিবার, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক জীবন পরিচালনার জন্য দিকনির্দেশনা দেয়। আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ جَعَلۡنٰكَ عَلٰی شَرِیۡعَۃٍ مِّنَ الۡاَمۡرِ فَاتَّبِعۡهَا
“তারপর আমি তোমার জন্য একটি শরিয়াহ নির্ধারণ করলাম জীবনব্যবস্থা হিসেবে—সুতরাং তুমি তা অনুসরণ করো।” (আল-জাসিয়া: ১৮) আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন:
اَفَحُكۡمَ الۡجَاهِلِیَّۃِ یَبۡغُوۡنَ ؕ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰهِ حُكۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ
“তবে কি তারা অজ্ঞদের বিধান চায়? অথচ বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহর বিধান অপেক্ষা উত্তম বিধান আর কী আছে?” (আল-মায়িদাহ: ৫০) রাসূল (সা.) বলেন:
تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بهِمَا : كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيهِ وسلَّمَ
“আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি—যদি তা আঁকড়ে ধরো, কখনো বিভ্রান্ত হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ।” (মুওয়াত্তা মালিক: ১৬০১) বিপরীতে যারা আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়াত অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করবেনা তারা জালিম। কুরআনে এসেছে-
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللهُ فَأُلٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ.
“যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই জালিম।” (মায়িদাহ: ৪৫)
২. ইসলামী শরিয়াহর পরিসর: জীবনব্যাপী নির্দেশনা
বিষয় | শরিয়াহর দিকনির্দেশনা | দলিল |
ইবাদত | সালাত, সাওম, হজ্ব, যাকাত | সূরা বাকারা: ৪৩, ১৮৩ |
ব্যক্তিগত নৈতিকতা | সত্যবাদিতা, আমানত, ধৈর্য | সূরা আহযাব: ৭০ |
পারিবারিক জীবন | বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার | সূরা নিসা: ৭, ১১ |
অর্থনীতি | সুদ নিষেধ, হালাল বাণিজ্য | সূরা বাকারা: ২৭৫ |
ফৌজদারি বিচার | হুদুদ, কিসাস, তায়জীর | সূরা মায়িদাহ: ৩৮, সূরা বাকারাহ: ১৭৮ |
রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা | শূরা, ইনসাফ, জবাবদিহি | সূরা শূরা: ৩৮ |
৩. ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য: শরিয়াহর মূল লক্ষ্য পাঁচটি মৌলিক উদ্দেশ্য রক্ষা করা:
১. দ্বীন রক্ষা; ২. জীবন রক্ষা; ৩. আকল (বুদ্ধি) রক্ষা; ৪. বংশ রক্ষা; ৫. সম্পদ রক্ষা;
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡكَ الۡكِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِتَحۡكُمَ بَیۡنَ النَّاسِ بِمَاۤ اَرٰىكَ اللّٰهُ
“আমি তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষের মাঝে বিচার করো—যা আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন সেই অনুযায়ী।” (আন-নিসা: ১০৫)
ইসলামী শরিয়াহ কেবল কিছু দণ্ডবিধি নয়—বরং এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নাযিলকৃত দিকনির্দেশনা। ব্যক্তিগত পবিত্রতা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় শাসন পর্যন্ত শরিয়াহ বাস্তবায়ন মানেই একটি ন্যায়, মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
৪. বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা
ক. ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকা বহু শতাব্দী ধরে ইসলামি সংস্কৃতি ও শরিয়াহ-ভিত্তিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত। ১৩শ শতক থেকে ইসলামের মুজাহিদ, দাঈ, সুফি ও ওলিদের দাওয়াহর মাধ্যমে এখানকার মানুষের মাঝে ইসলাম বিস্তার লাভ করে।
▶ ইসলাম এখানে কেবল ধর্ম নয়, বরং সংস্কৃতি, বিচার, শিক্ষা, ও অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তি হয়ে উঠেছে।
▶ ব্রিটিশ শাসনামলেও মুসলমানদের পারিবারিক ক্ষেত্রে শরিয়াহ বহাল ছিল (মুসলিম পার্সোনাল ল’), যা এখনো কার্যকর রয়েছে।
খ. ধর্মীয় ও জনমতভিত্তিক পটভূমি:
বাংলাদেশের ৯০%–এর বেশি মানুষ মুসলমান এবং ধর্মীয় অনুশাসন তাঁদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। নামাজ, রোজা, হালাল-হারামের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আত্মিক শ্রদ্ধা রয়েছে। এ ধর্মীয় চেতনা শরিয়াহ বাস্তবায়নের সামাজিক ভিত্তিকে দৃঢ় করে।
গ. শরিয়াহভিত্তিক অর্থব্যবস্থার প্রসার:
বাংলাদেশে বর্তমানে ১০+ ইসলামী ব্যাংক, শতাধিক ইসলামী শাখা, হালাল ইনভেস্টমেন্ট, ইসলামী মাইক্রোফিন্যান্স, টাকাফুল (ইসলামী বিমা) ব্যবস্থা রয়েছে। এটি শরিয়াহর অর্থনৈতিক বিধানের এক সফল উদাহরণ। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
اَحَلَّ اللّٰهُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا
“আল্লাহ বাণিজ্যকে হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন।” (আল-বাকারা: ২৭৫)
রাসূল (সা.) বলেন:
عَنْ جَابِرٍ، قَالَ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ
জাবির (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা’নাত করেছেন সুদখোরের উপর, সুদদাতার উপর, এর লেখকের উপর ও তার সাক্ষী দু’জনের উপর এবং বলেছেন এরা সবাই সমান। (সহীহ মুসলিম: ১৫৯৮)
এই সুদহীন অর্থব্যবস্থার বিধান বাস্তবায়নে ইসলামী ব্যাংকিং সফলভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে জনসাধারণের মাঝে। এবং জনগণও এই ব্যবস্থাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে চায়।
ঘ. উলামা ও শরিয়াহভিত্তিক শিক্ষিত সমাজের উপস্থিতি বৃদ্ধি:
বাংলাদেশে কওমি ও আলিয়া উভয় মাদ্রাসা শিক্ষায় শরিয়াহ বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে আসা শিক্ষার্থীদেরকে দেশের সর্বস্তরে কাজের সুযোগ প্রদানে ইতিমধ্যে তাদের সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে মাস্টার্স সমমান করা হয়েছে, যা শরিয়াহভিত্তিক প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
ঙ. ইসলামি দাওয়াহ ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি:
বর্তমানে ইসলামি চিন্তাবিদ, স্কলার, প্রভাবশালী ইউটিউবার ও বক্তারা ইসলামী আইন ও শরিয়াহর মূল উদ্দেশ্য (Maqasid al-Shariah) ব্যাপকভাবে প্রচার করছেন।
- প্রযুক্তির ব্যবহার: ইসলামি অ্যাপ, ইসলামিক টিভি চ্যানেল;
- যুব সমাজে রমজান, ইসলামি পোশাক, হালাল খাদ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে;
চ. বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজব্যবস্থায় শরিয়াহর প্রচল:
আজও বাংলাদেশের পরিবার, বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত হয়।
- কাবিন, মোহরানা, তালাকের বিধি
- মেয়ের সম্পত্তিতে অধিকার (আংশিক প্রয়োগ হলেও প্রচলিত)
৫. বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ ও প্রতিবন্ধকতা
ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নের জন্য যেমন আশা ও ভিত্তি রয়েছে, তেমনি কিছু বাস্তবিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে—যা শরিয়াহ-ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো গঠনের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক. আইনগত ও সাংবিধানিক দ্বিচারিতা:
▶ একদিকে বাংলাদেশ সংবিধানের ২(ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম,
▶ অন্যদিকে ৮(১) ও ১২ ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় নিরপেক্ষতার আদর্শ রাখা হয়েছে। এতে দ্বিধান্বিত নীতিকাঠামো তৈরি হয়, যা শরিয়াহ ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আইনি অসুবিধা সৃষ্টি করে।
অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“তোমরা কি কুরআনের কিছু অংশ বিশ্বাস করো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? অতএব তোমাদের যারা এমন করে তাদের পার্থিব জগতে লাঞ্ছনা ও অবমাননা ছাড়া আর কী প্রতিদান হতে পারে? এবং ক্বিয়ামাতের দিন তারা কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে, আর তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল নন। (বাকারা: ৮৫)
এই দ্বৈত নীতির ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা হওয়া। অধিকাং ইসলাম পন্থরা শরিয়াহর ব্যাপারে আশাবাদী থাকলেও ইসলাম বিদ্বেষীরা এই নীতিকে সামনে রেখে তাদের অবস্থান শক্ত করে।
খ. ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও মিডিয়া প্রপাগাণ্ডার প্রভাব:
ইসলামি আইন নিয়ে মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত সমালোচনা করা হয়—হুদুদ, কিসাস, নারীর অধিকার ইত্যাদি বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে ভয় দেখানো হয়।
▶ অনেকে শরিয়াহকে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ বা ‘মধ্যযুগীয়’ ভাবেন—যা মূলত অজ্ঞতা বা প্রোপাগান্ডার ফল।
মূলত প্রত্যেক যুগেই প্রপাগাণ্ডা তথা ব্যাপক প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তি হিসেবে কাজ করে। তবে যুগের ভিন্নতার প্রপাগাণ্ডার ধরণ ভিন্ন হয়। বর্তমান সময়ে মিডিয়ার প্রপাগাণ্ডা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী। যেটা রাসূল সা. এর যুগে কবিতার মাধ্যমে মানুষ প্রপাগাণ্ডা করত। রাসূল সা. এর যুগে সাহাবী কবি হাসসান ইবনে সাবিত রা. ইসলামের পক্ষে কাফিরদের বিপক্ষে কবিতা আবৃত্তি করতেন। রাসূল সা. নিজেই হাসসান রা. এর জন্য দুআ করতেন। হাদীসে এসেছে-
أَجِبْ عَنِّي اللَّهُمَّ أَيِّدْهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ
রাসূল সা. বলেন, হে হাসসান, তুমি আমার পক্ষ হতে উত্তর দাও। হে আল্লাহ! তাকে পবিত্র আত্মা (জিবরীল) দ্বারা সহযোগিতা করো। (মুসলিম: ২৪৮৫)
গ. মুসলিম সমাজে বিভক্তি ও ফেরকা সংকট:
– প্রথমত দেশের সাধারণ ও নেতৃস্থানীয় মুসলিমগণ মাজহাব, মতবাদ, পীর-মুরিদি ও রাজনৈতিক ইত্যাদি নানা মতভেদে বিভক্ত, ফলে ইসলামী চিন্তায় ঐক্যের চরম ঘাটতি রয়েছে।
– বিভিন্ন সংগঠন ও দলীয়ভিত্তিতে যারা ইসলামী শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত, কখনো তাদের অসুস্থ
অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا
“তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে একত্রে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” (আল-ইমরান: ১০৩)
হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” لاَ تَحَاسَدُوا وَلاَ تَنَاجَشُوا وَلاَ تَبَاغَضُوا وَلاَ تَدَابَرُوا وَلاَ يَبِعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا . الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ . التَّقْوَى هَا هُنَا ” . وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ” بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ ”
আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা পরস্পর হিংসা করো না, পরস্পর ধোকাবাজি করো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশে অগোচরে শত্রুতা করো না এবং একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর অত্যাচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না। তাকওয়া এখানে, এ কথা বলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার তার বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইযযত-আবরু হারাম। (মুসলিম: ২৫৬৪)
এই মতভেদ ও অনৈক্যের সংকট থেকে নিজেরা বের হতে না পারলে হয়ত আল্লাহও মুসলিমদেরকে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিবেন না। কেননা আল্লাহ তা’আলা কুরআনে বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ لَا یُغَیِّرُ مَا بِقَوۡمٍ حَتّٰی یُغَیِّرُوۡا مَا بِاَنۡفُسِهِمۡ
নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। (রা’দ: ১১)
ঘ. ইসলামি শিক্ষার অনুপস্থিতি ও জ্ঞানের দুর্বলতা:
– সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় শরিয়াহর স্থান নেই, ফলে দেশের আপামর মুসলিম জনগণ ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে আবেগ ও উৎসাহ থাকলেও শরিয়াহ ব্যবস্থার ব্যাপারে রয়েছে পূর্ণ অজ্ঞতা;
– যেহেতু সাধারণ মুসলিম জনগণ শরিয়াহ ব্যবস্থার ব্যাপারে ন্যূনতম ধারণা রাখেনা তাই তারা শরিয়াহর কথা শুনলে ভীত হোন;
– সবচেয়ে বড় সংকট হলো- সমাজের অনেক আলিম শরিয়াহ ব্যবস্থাপনা ও বিশেষত ইসলামের ফৌজদারি আইন তথা হুদুদ ও কিসাস ব্যাখ্যায় দুর্বল। এজন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰهَ مِنۡ عِبَادِهِ الۡعُلَمٰٓؤُا
প্রকৃত জ্ঞানীরাই কেবল আল্লাহকে ভয় করতে পারে। (কারণ অজ্ঞরা তো কীভাবে ভয় করবে সেটাই জানেনা) (ফাতির: ২৮)
– অনেকেই মনে করেন, শরিয়াহ মানেই নারীর অধিকার সংকোচন, অথচ ইসলামই প্রথম নারীকে উত্তরাধিকার, শিক্ষা, মতামত, নেতৃত্বের অধিকার দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে এই ব্যাপারে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
لِلرِّجَالِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اكۡتَسَبُوۡا ؕ وَ لِلنِّسَآءِ نَصِیۡبٌ مِّمَّا اكۡتَسَبۡنَ
পুরুষদের জন্য রয়েছে অংশ, তারা যা উপার্জন করে তা থেকে এবং নারীদের জন্য রয়েছে অংশ, যা তারা উপার্জন করে তা থেকে (নিসা: ৩২)। শুধু ইসলাম নারীদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে ও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করতে নারীদের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন:
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ حَتَّى تَبْلُغَا جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَنَا وَهُوَ ” . وَضَمَّ أَصَابِعَهُ
আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুটি মেয়ে সন্তানকে সাবালক হওয়া পর্যন্ত প্রতিপালন করে, কিয়ামতের দিনে সে ও আমি এমন পাশাপাশি অবস্থায় থাকব, এ বলে তিনি তার হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে দিলেন। (মুসলিম: ২৬৩১)
ঙ. সমাজে শরীয়াপন্থীদের দুর্বল অবস্থান:
শুধু ইসলামী শরীয়াহ নয়, যে কোন আদর্শ কিংবা মতবাদ বাস্তবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্ট মতাদর্শের সমর্থক ও নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে সামাজিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে হয়। অন্যথায়, সাধারণ জনগণ উক্ত মতাদর্শের পক্ষে নিরবে সমর্থন করলেও প্রকাশ্যে সমর্থন করার সাহস পায়না। কেননা, সমাজের মাজলুম, অসহায় জনগণ জালিম ও অত্যাচারী লোকদের ভয়ে ভীত থাকে। তাই যদি কোন ইসলামী শরীয়াহপন্থী ইনসাফকারী নেতা ও জনগোষ্ঠী সমাজের মাজলুম ও অসহায় জনগণকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে সমাজের অসহায় জনগোষ্ঠী কখনো শরীয়াতের পক্ষে কথা বলবে না। এই ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে এসেছে-
فَلَا اقۡتَحَمَ الۡعَقَبَۃَ – وَ مَاۤ اَدۡرٰىكَ مَا الۡعَقَبَۃُ – فَكُّ رَقَبَۃٍ – اَوۡ اِطۡعٰمٌ فِیۡ یَوۡمٍ ذِیۡ مَسۡغَبَۃٍ – یَّتِیۡمًا ذَا مَقۡرَبَۃٍ – اَوۡ مِسۡكِیۡنًا ذَا مَتۡرَبَۃٍ – ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ.
সাধারণত মানুষ আকাবাহ (কঠিন সংকটময় পথ) অতিক্রম করতে চায়না। তুমি কি জান সেই আকাবাহ কী? তা হলো-
১. দাসত্ব থেকে মুক্তিদান। ২. দুর্ভিক্ষের দিনে খাবার দান করা। ৩. নিকটবর্তী ইয়াতিমকে আশ্রয়দান। ৪. মিসকিন নিঃস্ব জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানো। ৫. অতপর চূড়ান্তভাবে সে মু’মিনদের মধ্যে শামিল হয়। ৬. (অন্যায় প্রতিরোধে) পরস্পরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয় ও নিজে ধৈর্যর সাথে অন্যায় মোকাবিলা করে। ৭. দয়া প্রদর্শনের উপদেশ দেয়। (বালাদ: ১১- ১৭)
উপরোক্ত সাতটি বিষয় হলো সমাজে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করা ও নেতৃত্ব লাভের অন্যতম মাধ্যম।
চ. আন্তর্জাতিক চাপের বাস্তবতা:
– ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
- ভারত দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থান, বাণিজ্য নির্ভরতা, জলসম্পদ চুক্তি, বিদ্যুৎ আমদানি প্রভৃতিতে ভারতের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
- ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যদি বাংলাদেশে শরিয়াহ আইন ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হয়, তবে তা তাদের তথাকথিত “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি” ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ফলে ভারত তার রাজনৈতিক প্রভাব, মিডিয়া, এনজিও ও কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে।
– যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক চাপ
- যুক্তরাষ্ট্র “গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর”-এর পর থেকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামী আইন বা শরিয়াহর কোনো প্রকার অগ্রগতিকে সন্দেহের চোখে দেখে।
- তারা শরিয়াহ বাস্তবায়নকে প্রায়ই “মানবাধিকার লঙ্ঘন” ও “নারী অধিকার সংকোচন” হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরে।
- যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক চাপের হাতিয়ার ব্যবহার করে যেমন: জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের হুমকি; ডলার লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা; আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শর্তারোপ।
ফলে যদি শরিয়াহ বাস্তবায়ন নিয়ে কোন সরকার দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে চায়, তবে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরির হুমকি থাকে।
এককথায় বলা যায়, ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে—জ্ঞানহীনতা, বিভাজন, মিডিয়া-নির্ভর ভুল ধারণা, আইনি দ্ব্যর্থতা, শরীয়াপন্থীদের দুর্বল অবস্থান ও আন্তর্জাতিক চাপ। এগুলোর সমাধান না হলে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও ভুল ব্যাখ্যার শিকার হবে।
৬. করণীয় ও সুপারিশ
ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়ন কেবল একটি ধর্মীয় দাবি নয়, বরং এটি মানবকল্যাণ, ইনসাফ ও নৈতিক পুনর্গঠনের পথ। কিন্তু একে বাস্তবায়ন করতে হলে কেবল আইনি কাঠামো নয়—প্রয়োজন শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও দাওয়াহ ভিত্তিক প্রস্তুতি। নিচে কুরআন ও সহীহ হাদীসের দলিলসহ সেই প্রয়োজনীয় করণীয় ও সুপারিশগুলো তুলে ধরা হলো।
ক. সঠিক শরিয়াহভিত্তিক শিক্ষা বিস্তার ও জ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন:
▶ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শরিয়াহর মৌলিক জ্ঞান সংযুক্ত করতে হবে।
▶ উলামা এবং ইসলামি স্কলারগণ শরিয়াহর উদ্দেশ্য (مَقَاصِدُ الشَّرِيْعَةِ) জনসাধারণকে বোঝাতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ كُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّهُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَهُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ یَحۡذَرُوۡنَ
অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে। (তাওবা: ১২২)
খ. উলামা-মাশায়েখ ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বাস্তবিক সমন্বয়:
▶ ইসলামি চিন্তাবিদ ও আলেমদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
▶ ফতোয়া বোর্ড, শরিয়াহ কাউন্সিল, ইসলামি অর্থনৈতিক ফোরাম—এসবকে সরকারিভাবে প্রভাবশালী করতে হবে।
গ. গণমাধ্যম ও অন্যান্য সকল মিডিয়ায় শরিয়াহর ইতিবাচক দিক তুলে ধরা:
▶ মিডিয়া, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম, ইউটিউব, টিভি—সবখানে শরিয়াহকে “শাস্তি নয়, ন্যায়ের ভাষা” হিসেবে তুলে ধরতে হবে। এই ব্যবস্থা জাতির জন্য রহমত, তা তুলে ধরতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:
وَ لَقَدۡ جِئۡنٰهُمۡ بِكِتٰبٍ فَصَّلۡنٰهُ عَلٰی عِلۡمٍ هُدًی وَّ رَحۡمَۃً لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
আর আমি তো তাদের নিকট এমন কিতাব নিয়ে এসেছি, যা আমি জ্ঞানের ভিত্তিতে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি। তা হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ এমন জাতির জন্য, যারা ঈমান রাখে। (আ’রাাফ: ৫২)
▶ শরিয়াহ মানেই ‘কাটা-ছেঁড়া’ নয়, বরং সমাজ রক্ষার মানবিক আইনব্যবস্থা—এটি সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে।
ঘ. দাওয়াহ, গবেষণা ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ:
▶ শরিয়াহ বিষয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ, সেমিনার ও ডকুমেন্টারি তৈরি করা;
▶ ইসলামি আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপ আয়োজন করা; আল্লাহ তা’আলা বলেন:
اُدۡعُ اِلٰی سَبِیۡلِ رَبِّكَ بِالۡحِكۡمَۃِ وَ الۡمَوۡعِظَۃِ الۡحَسَنَۃِ وَ جَادِلۡهُمۡ بِالَّتِیۡ هِیَ اَحۡسَنُ ؕ
“হিকমা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর।” (নাহল: ১২৫)
ঙ. সামাজিকভাবে শক্তিশালী হওয়া: এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় দিক হলো-
– সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো
- যত বড় বিপদই হোক সমাজে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে হলে সবার আগে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে হবে;
- প্রয়োজনে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে অন্যায়কারী ও জালিমের মুকাবিলা করতে হবে।
যেমন, রাসূল সা. ইসলামের প্রথম যুগে সামাজিকভাবে নৈতিক দিক থেকে, জ্ঞানগত দিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি এতিম, মিসকিন, বিধবা তথা সমাজের দুর্বল মানুষদের পাশে দাঁড়াতেন এবং দাস-দাসীদেরকে মুক্ত করতেন। এই বিষয়ে হাদীসে এসেছে- (প্রথম ওহী পাওয়ার পর খাদিজা রা. এর শান্ত্বনা)
– দাসত্বের শৃংখল থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে
- যুগে যুগে সংখ্যায় অল্প জালিমগণ বৃহৎ সংখ্যক মাজলুম জনগোষ্ঠীকে দাসত্বের শৃংখলে বন্দী করে রাখে;
- শরীয়াতপন্থী সমর্থক ও নেতৃবৃন্দ সাহস করে ঝুঁকি নিয়ে জালিমের উন্মুক্ত কারাগার থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে হবে।
যেমন, আল্লাহ তা’আলা মূসা আ.কে নবুয়্যাত দেওয়ার সাথে সাথে মূসা আ. এর আজন্ম শত্রু ফিরআউনের নিকট সরাসরি পাঠিয়েছিলেন। যেন ফিরআউন তার দেশে অবস্থারত “বনী ইসরাঈল” জাতিকে মুক্ত করে দেয়। কেননা, ফিরআউন দীর্ঘ সময় ধরে বনী ইসরাঈল জাতিকে দেশের মধ্যে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তাদের উপর সার্বক্ষণিক অত্যাচার নির্যাতন করতেন। পবিত্র কুরআনে এসেছে-
إِذْهَبْ إِلَى فِرْفَونَ إِنًّهُ طَغَى
হে মূসা তুমি ফিরআউনের কাছে যাও, কেননা সে সীমালঙ্ঘনকারী (ত্বহা: ২৪)।
পরবর্তী আয়াতে মূসার পক্ষ থেকে ফিরআউনকে কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেটি বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
فَاۡتِیٰهُ فَقُوۡلَاۤ اِنَّا رَسُوۡلَا رَبِّكَ فَاَرۡسِلۡ مَعَنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ ۬ۙ وَ لَا تُعَذِّبۡهُمۡ ؕ
সুতরাং তোমরা দু’জন তার কাছে যাও অতঃপর বল, ‘আমরা তোমার রবের দু’জন রাসূল। সুতরাং তুমি বনী ইসরাঈলকে (দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত করে) আমাদের সাথে যেতে দাও এবং তাদেরকে আর নির্যাতন করো না। (ত্বহা: ৪৭)
চ. শক্ত হাতে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা: এক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ করণীয় দিক হলো-
– কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা
- শরিয়াহ বাস্তবায়নকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক মহলে বেশি আলোচনা সৃষ্টি না হয়।
- শরিয়াহর ইতিবাচক দিক যেমন: মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, ন্যায়বিচার, এগুলোকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরা।
- ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা বিষয়ে উইন-উইন কৌশল গ্রহণ করা।
– অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি
- বিদেশি চাপ কমাতে রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ (চীন, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার দিকে রপ্তানি বৃদ্ধি করা)
- ইসলামী অর্থব্যবস্থা শক্তিশালী করে সুদভিত্তিক বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমানো
- রেমিট্যান্স প্রবাহ ও হালাল শিল্প খাত উন্নয়ন করে অর্থনৈতিক স্থিতি শক্ত করা।
– আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করা
- শরিয়াহকে “মানবিক ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা” হিসেবে তুলে ধরে গবেষণা, কনফারেন্স ও মিডিয়া প্রচারণা চালানো।
- আন্তর্জাতিক মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে কার্যকরী ঐক্য করা।
– গণসচেতনতা বৃদ্ধি
- বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সঠিক ধারণা প্রচার করা যে শরিয়াহ মানেই “অত্যাচার” নয়—বরং দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা।
- পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা মোকাবিলায় অনলাইন ও অফলাইনে দাওয়াহ কার্যক্রম বাড়ানো।
আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও, কৌশলী কূটনীতি, অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি, শরিয়াহর মানবিক দিক প্রচার এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য—এই চারটি উপায়ে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে ইসলামী শরিয়াহর পথে অগ্রসর হতে পারে।
ছ. সমাজকে পর্যায়ক্রমে প্রস্তুত করা ও ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন:
▶ হঠাৎ করে শরিয়াহ চাপিয়ে না দিয়ে সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে:
– প্রথম ধাপে শিক্ষা, চিকিৎসা ও অর্থনীতিতে সফলতার সাথে ইসলামের মডেল উপস্থাপন করতে হবে;
– দ্বিতীয় ধাপে ইসলামের আলোকে পারিবারিক ও সামাজিক বিধানাবলী সংস্কার করতে হবে;
– তৃতীয় ধাপে ইসলামের আলোকে প্রশাসনিক আইন ও দণ্ডবিধির সংস্কার করতে হবে।
ইসলামী শরিয়াহ বাস্তবায়ন একটি গঠনমূলক কাজ, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ইচ্ছায় নয়—বরং শিক্ষা, দাওয়াহ, গণসচেতনতা ও নৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য। কুরআন ও হাদীস আমাদেরকে “সহমর্মিতা ও হিকমার” মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করার নির্দেশ দিয়েছে ।
উপসংহার:
বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের আলোচনায় আমরা দেখেছি—এটি কেবল ধর্মীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং একটি নৈতিক, সামাজিক ও মানবিক বিপ্লবের রূপরেখা। শরিয়াহ মানেই কেবল “আইন প্রয়োগ” নয়, বরং এটি হলো এক আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির পথ। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।” (আম্বিয়া: ১০৭)
এই রহমতের প্রতিফলন হলো:
– ইনসাফপূর্ণ বিচার
– দুর্নীতিমুক্ত সমাজ
– নারী-পুরুষের মর্যাদা রক্ষা
– পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য
বর্তমান বাংলাদেশের অনেক সামাজিক অনাচার—দুর্নীতি, নারীর নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয়—এসবের পেছনে শরিয়াহভিত্তিক জীবনব্যবস্থার অভাবই মূল কারণ। “হে আল্লাহ! আমাদের এমন একটি সমাজ দান করো, যেখানে সত্য ও ইনসাফ রাজত্ব করে, এবং ইসলামী শরিয়াহ আমাদের ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।”
উপরোক্ত বয়ানের আরবী অনুবাদ (সংক্ষিপ্ত ও মূলবক্তব্য)
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ، أَمَّا بُعْدُ . . . . . . . . . . . . . . .
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ – مَوْضُوعُنَا اليَوْمِ : إِمْكَانِيَّاتُ تَطْبِيقِ الشَّرِيعَةِ الْإِسْلَامِيَّةِ فِي بَنْغَلَادِيش وَتَحَدِّيَاتُهُ.
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ -أَوَّلًا أُلْقِي أَمَامَكُمْ إِمْكَانِيَّاتِ تَطْبِيقِ الشَّرِيعَةِ اَلْإِسْلَامِيَّةِ فِي بَنْغَلَادِيش
أَوَّلًا. اَلسِّيَاقُ التَّارِيخِيُّ وَالثَّقَافِيُّ:
تَأَثَّرَتِ الْمِنْطَقَةُ الْجُغْرَافِيَّةُ لِبَنْغَلَادِيش بِالثَّقَافَةِ الْإِسْلَامِيَّةِ وَقِيَمِ الشَّرِيعَةِ الْإِسْلَامِيَّةِ لِقُرُونِ عَدِيدَةٍ. اِنْتَشَرَ الْإِسْلَامُ بَيْنَ النَّاسِ هُنَا مِنْ خِلَالِ دَعْوَةٍ الْمُجَاهِدِينَ وَالدُّعَاةِ وَالصُّوفِيَّةِ وَالْأَوْلِيَاءِ مُنْذُ الْقَرْنِ اَلثَّالِثِ عَشَرَ.
ثَانِيًا. اَلْخَلْفِيَّةُ الدِّينِيَّةُ وَالرَّأْيُ الْعَامُّ: أَكْثَرَ مِنْ تِسْعِينَ فِي المِئَةِ مِنْ سُكَّانِ بَنْغَلَادِيش مُسْلِمُونَ، وَتُعَدُّ الشَّعَائِرُ الدِّينِيَّةُ جُزْءًا لَا يَتَجَزَّأُ مِنْ حَيَاتِهِمْ. يَحْتَرِمُ مُعْظَمُ النَّاسِ اِحْتِرَامًا رُوحِيًّا لِلصَّلَاةِ وَالصِّيَامِ وَالْحَلَالِ وَالْحَرَامِ. هَذَا الْوَعْيِ الدِّينِيِّ يُعَزِّزُ الْأَسَاسَ الِاجْتِمَاعِيَّ لِتَطْبِيقِ الشَّرِيعَةِ.
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ الآنَ أُلْقِي أَمَامَكُمْ تَحَدِّيَاتِ تَطْبِيقِ الشَّرِيعَةِ اَلْإِسْلَامِيَّةِ:
أَوَّلًا. اَلْغُمُوضُ الْقَانُونِيُّ وَالدُّسْتُورِيُّ: كَمَا قَالَ اللهُ فِي القُرآنِ: اَفَتُؤۡمِنُوۡنَ بِبَعۡضِ الۡكِتٰبِ وَ تَكۡفُرُوۡنَ بِبَعۡضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنۡ یَّفۡعَلُ ذٰلِكَ مِنۡكُمۡ اِلَّا خِزۡیٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یُرَدُّوۡنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الۡعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ.
ثَانِيًا. اَلِانْقِسَامُ وَالْأَزْمَةُ الطَّائِفِيَّةُ فِي الْمُجْتَمَعِ اَلْإِسْلَامِيِّ: كَمَا قَالَ اللهُ فِي القُرآنِ: وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا.
ثَالِثًا: غِيَابُ التَّعْلِيمِ الْإِسْلَامِيِّ وَضَعْفِ الْمَعْرِفَةِ: كَمَا قَالَ اللهُ فِي القُرآنِ: اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰهَ مِنۡ عِبَادِهِ الۡعُلَمٰٓؤُا.
رَابِعًا: ضَعْفُ مَكَانَةِ زُعَمَاءِ الشَّرِيعَةِ فِي الْمُجْتَمَعِ: كَمَا قَالَ اللهُ فِي القُرآنِ: فَلَا اقۡتَحَمَ الۡعَقَبَۃَ – وَ مَاۤ اَدۡرٰىكَ مَا الۡعَقَبَۃُ – فَكُّ رَقَبَۃٍ – اَوۡ اِطۡعٰمٌ فِیۡ یَوۡمٍ ذِیۡ مَسۡغَبَۃٍ – یَّتِیۡمًا ذَا مَقۡرَبَۃٍ – اَوۡ مِسۡكِیۡنًا ذَا مَتۡرَبَۃٍ – ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَوَاصَوۡا بِالصَّبۡرِ وَ تَوَاصَوۡا بِالۡمَرۡحَمَۃِ.
بَارَكَ اللَّهُ لِي وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيمِ، وَنَفَعَنِي وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيهِ مِنَ الْايَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ. أَقُولُ قَوْلِي هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الْجَلِيل، لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِينَ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرُوه أَنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
সংকলন, সম্পাদনা, পরিমার্জন ও আরবী তরজমা: ইমরান মাহমুদ (পিএইচডি গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাবি) পুনর্মূল্যায়ন: মুফতি ইসমাঈল হোসাইন (খতিব ও দাঈ)