৪৭ থেকে ২৪: ঐতিহাসিক বোঝাপড়া

আরিফুল ইসলাম আবির, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মোবাইল: +880 1774-114486

Abstract

The history of Bengal is marked by a continuous struggle for political, economic, and cultural sovereignty. Despite periodic shifts in governance—from British colonial rule to Pakistani dominance and finally to nominal independence—the Bengali people have persistently aspired to true liberation. The essay traces the trajectory of this struggle, beginning with the 1757 Battle of Plassey, which ushered in the exploitative zamindari system under British rule, depriving peasants of land ownership and economic freedom. Religious discrimination against Muslim farmers further entrenched systemic oppression. The Partition of 1947 initially brought hope, as the end of the zamindari system under East Pakistan offered partial economic relief and religious freedom. However, political and economic exploitation by West Pakistan soon became evident, as East Bengal contributed the majority of national revenue while receiving minimal returns. Cultural suppression—epitomized by the imposition of Urdu—triggered resistance, culminating in the 1971 Liberation War. While this war freed Bangladesh from Pakistan’s grip, it introduced new challenges. Indian geopolitical influence and the Awami League’s governance under Sheikh Hasina are argued to have led to a new form of dependency and authoritarianism. The essay posits that the student-led uprising of July 2024 represents a renewed pursuit of authentic sovereignty, breaking away from both Pakistani and Indian hegemony. The narrative emphasizes that true independence entails not just territorial control but also cultural autonomy, economic justice, and national self-respect. The journey toward full independence remains ongoing, reflecting a deep-rooted collective desire for dignity, equity, and freedom in all spheres of national life.

‍ভূমিকা: বাংলার ইতিহাস এক সংগ্রামের ইতিহাস। এটি ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি স্বতন্ত্র অঞ্চল, যা বারবার বৈদেশিক শাসন এবং অভ্যন্তরীণ শোষণের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এর মানুষ বরাবরই স্বাধীনচেতা এবং নিজেদের পরিচিতি রক্ষায় আপসহীন।

স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ডের অধিকার নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, শোষণমুক্ত জীবনের স্বাদ, এবং সার্বভৌমত্বের বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের ইতিহাস এই সত্যের প্রমাণ বহন করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ বিশেষত মুসলমানরা ব্রিটিশ শাসন ও জমিদারি শোষনের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেলেও প্রকৃত স্বাধীনতার স্বপ্ন তখনও অধরা ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শোষণ ভেঙে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে আমরা হই ভারতের অধীন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশকে তার এক আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রে পরিণত করে। অবশেষে ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট  জাতি প্রকৃত স্বাধীনতার  পথের সন্ধান পায়। এই পথ ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের অধীনতা ও শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পথ। কিন্তু স্বাধীনতার পথে সফর শুরু হয়েছে মাত্র; এই সফরের পথ এখনো লম্বা।

পলাশী ট্র‍্যাজেডি: ব্রিটিশদের অধীন থেকে জমিদারদের শোষণময় শাসন

স্বাধীনতা দুই রকমের হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। ব্রিটিশদের মাধ্যমে জমিদারি শাসনের অধীনে গিয়ে আমরা দুই স্বাধীনতাই হারিয়েছি। এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মূলে ছিল কৃষি ও কৃষিজমি। বাংলার ইতিহাসে জমি ও ক্ষমতার প্রশ্ন বরাবরই রাজনৈতিক এবং সামাজিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। মুঘল শাসনামলে বাংলার জমি মূলত কৃষকদের দ্বারা চাষযোগ্য থাকলেও মালিকানা ছিল মুঘল বাদশাহের হাতে। মুঘলরা কৃষকদের থেকে ন্যায্য খাজনা আদায় করত  এবং এর একটি বড় অংশ স্থানীয় প্রশাসনে ব্যয় করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে বাংলা দখল করার পর জমি নিয়ে এক নতুন শোষণের অধ্যায়ের সূচনা করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং জমিদারি শাসনের উত্থান:

১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থায় জমির মালিকানা কৃষকদের পরিবর্তে জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কর্নওয়ালিস এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জমিদারদের কর আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত করেন এবং স্থায়ীভাবে খাজনার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঠিক করেন। জমিদাররা এই নির্দিষ্ট কর ব্রিটিশ সরকারের কাছে পরিশোধ করত এবং করের বাকি অংশ নিজেরা ভোগ করত। জমিদাররা কৃষকদের থেকে যতটা খাজনা চাইত, ততটাই আদায় করতে পারত। খাজনা নির্ধারণের কোনো নিয়মকানুন ছিল না। এই ব্যবস্থার ফলে জমিদাররা অতিরিক্ত কর চাপিয়ে কৃষকদের শোষণ করতে শুরু করে।

ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার উল্লেখ করেছেন, “চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা বাংলার কৃষকদের জীবনকে কেবল অর্থনৈতিক শোষণের শিকারই করেনি, বরং তাদের সামাজিকভাবে দাসত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছিল” (The History of Bengal, ১৯৪৮)।

জমিদারদের অধীন কৃষকের জীবন:

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাংলার কৃষকদের ভূমিহীনতা চরমে পৌঁছে। জমিদাররা কৃষকদের উপর কঠোর খাজনা আরোপ করত এবং খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের জমি দখল করে নিত। জমি হারিয়ে কৃষকেরা দিনমজুর বা বর্‌গাচাষীতে পরিণত হতো।

লেখক উইলিয়াম হান্টার তার বিখ্যাত বই The Indian Musalmans-এ লিখেছেন, “বাংলার মুসলমান কৃষকরা জমিদারদের কাছে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। কৃষকদের নিজেদের ফসল থেকে ন্যূনতম অংশও থাকত না, এবং তারা প্রায়শই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ত।”

কৃষকেরা শুধু অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়নি; বরং জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মাধ্যমে তারা শারীরিক এবং মানসিক নিপীড়নের সম্মুখীন হত। জমিদাররা কোনোভাবেই কৃষকদের নিজেদের জমির মালিকানা ফিরে পেতে দিত না।

ধর্মীয় শোষণ ও সাংস্কৃতিক অধীনতা:

কৃষকদের ওপর জমিদারদের শোষণ কেবল অর্থনৈতিক ছিল না; এটি ধর্মীয় ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হত। জমিদারদের অধিকাংশই ছিলেন কলকাতা-কেন্দ্রিক উচ্চবর্ণ হিন্দু, যারা মুসলমান কৃষকদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করত। আযান দেওয়া, মসজিদ নির্মাণ, বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রেও মুসলমানদেরকে আলাদা আলাদা কর দিতে হতো। এমনকি মুসলিম নাম রাখার জন্যও দিতে হতো কর। ব্রিটিশ পর্যটক রবার্ট ওরবিয়ান উল্লেখ করেন, “হিন্দু জমিদাররা মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার হরণ করতে কখনো দ্বিধা করত না। অনেক মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং ঈদ বা অন্যান্য উৎসব পালনে বাধা দেওয়া হয়েছিল” (A Journey Through Bengal, ১৯০৫)।

স্বাধীনতার আশা ও পাকিস্তান আন্দোলন:

জমিদারদের শাসনের এই কঠোর শোষণ এবং নিপীড়ন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে একটি মুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছিল। জনগণ মুক্তির আকাঙ্খা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে ‘জমিদারি বিলুপ্তি আইন’ প্রণয়ন করে, যা জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত  করে কৃষকদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করে দেয়।

ঐতিহাসিক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, “জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকদের প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ এনে দেয়”  (বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস, ১৯৮৫)।

পাকিস্তানের বৈষম্য: পূর্ববঙ্গের শোষণের চিত্র:

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের মানুষ জমিদারি শাসন থেকে মুক্তি পেলেও প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য, এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনার বৈষম্যের কারণে পূর্ববঙ্গ ক্রমেই শোষণের শিকার হতে থাকে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য:

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ থেকে অর্জিত রাজস্বের প্রায় ৭০% পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করত। অথচ পূর্ববঙ্গ ছিল পাকিস্তানের মূল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস, বিশেষত পাট রপ্তানির জন্য। ১৯৫০-এর দশকে পূর্ববঙ্গের পাট থেকে পাকিস্তান প্রায় ১৩০০ কোটি রুপি আয় করে, যার মাত্র ২৫% পূর্ববঙ্গের উন্নয়নে ব্যয় হয়(Rahman, M., Bangladesh Liberation War Documents, ১৯৭১)।

ভাষাগত বৈষম্য:

পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা পূর্ববঙ্গের মানুষের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের উপর আঘাত হানে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল এর সরাসরি প্রতিক্রিয়া।

ঐতিহাসিক সিতারা সাদিক লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গের মানুষ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য যে লড়াই করেছিল, তা পাকিস্তানের বিভক্তির প্রথম ইঙ্গিত ছিল” (The Untold Story of East Pakistan, ১৯৮০)।

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈষম্য:

পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হলেও কেন্দ্রীয় সরকার এবং সামরিক বাহিনীতে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে পশ্চিম পাকিস্তান তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক শাসন পূর্ববঙ্গের মানুষকে অর্থনৈতিক, ভাষাগত, এবং রাজনৈতিকভাবে শোষণ করেছিল। এই শোষণই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পথ তৈরি করে

পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় স্বাধীনতা:

পাকিস্তান রাষ্ট্র সাম্য এনে দিতে না পারলেও ধর্মীয় স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল পূর্ব বঙ্গের মানুষকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে। ব্রিটিশ শাসন এবং জমিদারি ব্যবস্থার অধীনে মুসলমানদের ধর্মীয় চর্চা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। আজান দেওয়া, মসজিদ নির্মাণ, এবং ধর্মীয় উৎসব পালনে জমিদারদের বাধা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক।

তবে পাকিস্তান আমলে এ ধরনের বাধার অবসান ঘটে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে, যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল মৌলিক অধিকার। পূর্ববঙ্গে মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণ, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, এবং তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতে স্বাধীনতা ভোগ করে।

লেখক আনিসুর রহমান উল্লেখ করেছেন, “পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা ধর্মীয় চর্চার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুকূল  পরিবেশে বসবাস করতে পেরেছিল, যা তাদের আত্মপরিচয়ের একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছিল” (The Rise of Muslim Identity in East Pakistan, ১৯৭৯)।

এই ধর্মীয় স্বাধীনতা ব্রিটিশ আমলে জমিদারদের নিপীড়নমূলক নীতির পর পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের জন্য একটি স্বস্তি এবং সামাজিক শান্তির সময় নিয়ে আসে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারতীয় আধিপত্যের সূচনা:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পূর্ববাংলার জনমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। এই যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের শোষণ, বৈষম্য, এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার লড়াই। ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং রাজনীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অবিচার দিনের পর দিন বাঙালির মনে ক্ষোভ তৈরি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে জাতি একত্র হয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু এই যুদ্ধে পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেলেও, সেই স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ভারতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে যুদ্ধকালীন সময়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে যে ৭ দফা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, তা স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এই চুক্তি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং কৌশলগত স্বাধীনতাকে সীমিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং ভারতের ভূমিকা:

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে বাঙালিদের হত্যা শুরু করলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানান এবং ভারতের সেনাবাহিনী, অস্ত্র, এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করে।

ভারতের এই সহযোগিতা মুক্তিযুদ্ধে জয় নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা পালন করলেও এর পেছনে ছিল কৌশলগত স্বার্থ। ভারত বাংলাদেশের উপর একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল।

তাজউদ্দীন আহমদের ৭ দফা চুক্তি:

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারত সরকার কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তা নিশ্চিত করলেও, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের প্রভাব স্থাপিত হয়।

চুক্তির ৭টি প্রধান দফা ছিল:

১. মুক্তিযুদ্ধের পরে ভারতীয় সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবে।

২. বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হবে।

৩. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে।

৪. বাংলাদেশের জলসম্পদ ব্যবহারের বিশেষ অধিকার ভারত পাবে।

৫. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিতে ভারতের সহযোগিতা এবং পরামর্শ বাধ্যতামূলক থাকবে।

৬. বাংলাদেশ থেকে ভারতে পণ্য পরিবহনে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে।

৭. বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিতে ভারত প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।

এই চুক্তির ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, ভারতীয় আধিপত্যের একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়।

স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং ভারতের আধিপত্য:

পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার স্বপ্নে বাংলাদেশ জন্ম নিলেও, ভারতের প্রভাব খুব দ্রুতই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যুদ্ধের পরে ভারতীয় সেনারা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করে। এই অবস্থান সাধারণ মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে, কারণ তারা পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে ভারতীয় প্রভাব দেখতে শুরু করে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ভারতের লুটপাট ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় গ্রেফতার হন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলার প্রথম রাজবন্দী। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় সেক্টর কমান্ডার হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো খেতাব পান নি।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং জলসম্পদ ব্যবহারের অধিকার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। ভারতের সহায়তায় গঠিত প্রথম জাতীয় বাজেটেও ভারতের স্বার্থ সংরক্ষিত ছিল।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত হওয়া শুরু হয়। বাংলাদেশ কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি বা সম্পর্ক গড়তে গেলে ভারতের অনুমতি নিতে বাধ্য ছিল। এমনকি, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিতেও ভারতীয় কর্মকর্তারা ভূমিকা রাখতেন।

তাজউদ্দীন আহমদ এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সংঘর্ষ

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান নীতি ছিল স্বাধীনতা এবং আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা। তবে তাজউদ্দীন আহমদের ৭ দফা চুক্তি এই আদর্শের সঙ্গে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক ছিল। ঐতিহাসিক আনিসুজ্জামান তার গবেষণায় উল্লেখ করেন, “৭ দফা চুক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর ভারতীয় আধিপত্য স্থাপনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। এটি মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ণ করেছিল” (বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনীতি, ১৯৯৫)।

চুক্তির প্রভাব মুক্তিযুদ্ধের পরপরই দৃশ্যমান হতে শুরু করে। ভারতের কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের উপর এমন একটি প্রভাব বজায় রাখা, যা তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য নিশ্চিত করবে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির শোষণ থেকে মুক্তির জন্য একটি ঐতিহাসিক লড়াই। তবে, এই লড়াইয়ে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি পেলেও, বাংলাদেশ ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের অধীন হয়ে যায়। তাজউদ্দীন আহমদের ৭ দফা চুক্তি এ প্রভাবের ভিত্তি স্থাপন করে, যা মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতার স্বপ্নকে সীমিত করে দেয়।

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, ভারতীয় আধিপত্যের অন্যতম প্রতীক:

বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচনের প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক ছিল না, বরং এটি ছিল রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপের ফলাফল। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল। সেই কৌশলগত সম্পর্কের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আমার সোনার বাংলা নির্বাচন করা হয়।

গণপরিষদের অমত এবং একক সিদ্ধান্ত:

জাতীয় সংগীত নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গণপরিষদের অধিকাংশ সদস্য ’আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। তাদের যুক্তি ছিল, এটি ভারতের জাতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এবং এটি বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয়তাবাদকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে না। তৎকালীন গণপরিষদের সদস্য আব্দুর রহমান সেদিন মন্তব্য করেছিলেন, “আমাদের জাতির জন্য এমন একটি সংগীত নির্বাচন করা উচিৎ, যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ও আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়কে প্রতিফলিত করে” (Rahman, A., The Controversy of National Symbols, ১৯৮৫)।

শেখ মুজিবের একক সিদ্ধান্তে আমার সোনার বাংলা জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়। ভারতীয় কবির লেখা গানকে জাতীয় সংগীত করার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তৎকালীন সময় থেকেই বিতর্ক ছিল। অনেকেই মনে করেন, এটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সম্প্রতি  একইরকম বক্তব্য দিয়েছেন ১৯৭৫ সালের অন্যতম বিপ্লবী মেজর ডালিম। বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব ইলিয়াস হোসাইনের সঞ্চালিত সরাসরি সম্প্রচারে এসে তিনি আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত করার সমালোচনা করেন (৬ই জানুয়ারি-২০২৫, মানবজমিন)। এছাড়াও কর্ণেল অলি আহমেদসহ অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা বলেছেন।

জাতীয় পতাকা এবং ভুল ব্যাখ্যা:

জাতীয় পতাকা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই পতাকার মাঝখানে ছিল লাল একটি বৃত্ত, যা ব্যাখ্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের প্রতীক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে ২৬ মার্চ, তাহলে এর আগেই ২ মার্চ কিভাবে শহিদের রক্ত আসল আর কিভাবে এই রক্তের প্রতিক জাতীয় পতাকায় স্থান পেলো?

পতাকার লাল বৃত্ত আসলে কমিউনিজমের প্রতীক ছিল বলে অনেক গবেষক দাবি করেছেন। গবেষক আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেছেন, “পতাকার লাল বৃত্ত মূলত ভারতীয় পরামর্শে কমিউনিস্ট ছাত্রদের মাধ্যমে আনা হয়েছিল, যা কমিউনিজমের প্রতি তাদের আনুগত্যের  উদাহরণ ” (The Flag Controversy of 1971)। ভারতের সাথে সরাসরি সহযোগিতা এবং পাকিস্তানকে দুর্বল করার কৌশলের অংশ হিসেবে এই প্রতীক বেছে নেওয়া হয়।

ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য:

জাতীয় সংগীত এবং পতাকা নিয়ে এই বিতর্ক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার প্রশ্নকে জটিল করে তুলেছে। ভারতীয় প্রভাব এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনার ওপর ভারতীয় আধিপত্যের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গভীর হলেও, কিছু ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্যের অভিযোগ উঠেছে। নিচে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাবের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক আলোচনা করা হলো:

১. নদীতে বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ:

ভারত তার উজানে বিভিন্ন নদীতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে, যা বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ফারাক্কা বাঁধ: ১৯৭৫ সালে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহ কমে যায়, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণ ও লবণাক্ততার সমস্যা সৃষ্টি করেছে।

তিস্তা নদী: উজানে গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করায় উত্তরবঙ্গের কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

২. সীমান্ত হত্যা:

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা উদ্বেগজনক। বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ১,২০০ বাংলাদেশি সীমান্তে নিহত হয়েছেন।

ফেলানি হত্যা ভারতের সিমান্ত আগ্রাসনের একটা অনন্য উদাহরণ। কাটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানিকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বলে প্রতিকায়িত করা হয়।

৩. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ:

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

১/১১ ঘটনা: ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের সময় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই পরিবর্তনে ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল।

নির্বাচনে প্রভাব: ২০১৪ ও ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভারতের সমর্থন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সমর্থন এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভারতের প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রচন্ড ক্ষোভ রয়েছে।

৪. অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ:

ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছে, যা কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হয়।

ট্রানজিট ও করিডোর: বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে। এ জন্য বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করা হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।

বন্দর ব্যবহার: ভারত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবকাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হলেও, প্রাপ্ত সুবিধা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা: ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে। ভারতীয় পণ্যের আমদানি বেশি হলেও, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে বিভিন্ন অশুল্ক বাধা রয়েছে।

৫. কুমিল্লায় কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টি:

সম্প্রতি (২০২৪) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার ফলে কুমিল্লা অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়। ভারতের দাবি, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে এবং বন্যার জন্য দায়ী তারা দায়ী নয়।  কিন্তু বিশ্লেষকদের দাবি এই বন্যা একটা কৃত্রিম বন্যা। অনেকে এটাকে রাজনৈতিক বন্যা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

উপরোক্ত বিষয়গুলো বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব ও আধিপত্যের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ধরনের কার্যক্রম দুই দেশের সম্পর্কে জটিলতা সৃষ্টি করে এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে আলোচনা ও সমঝোতা জরুরি।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড থেকে আবরার ফাহাদ হত্যা, ভারতীয় আধিপত্যবাদের অন্যতম দলিল:

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে। বিশেষত, ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের দমন, এবং ২০১৯ সালে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড—এসব ঘটনাকে ভারতের পরোক্ষ ইন্ধনের ফসল হিসেবে দেখা হয়। ভারতের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যেই এই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা  মনে করেন।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড, সামরিক শক্তি দুর্বল করার ষড়যন্ত্র: ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত বিদ্রোহে ৫৭ জন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এই ঘটনা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সংকট তৈরি করে। তৎকালীন তথাকথিত বিডিআর সদস্যদের অসন্তোষের আড়ালে লুকিয়ে ছিল একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র।

একাধিক তদন্তে বের হয়ে আসে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সরাসরি ভারতের হাত ছিল। বিদ্রোহের সময় অনেক তথ্য উঠে আসে, যা এই সন্দেহকে জোরদার করে। ভারতের কৌশল ছিল বাংলাদেশের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করা, যাতে দেশটি সামরিকভাবে কখনোই ভারতের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে না পারে। সাংবাদিক মহিউদ্দিন খান মোহন তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, “পিলখানা হত্যাকাণ্ড এমন এক সময় ঘটে, যখন বাংলাদেশে ভারতপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল এবং এই ঘটনার ফলাফল ছিল ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তা লক্ষ্য পূরণ।”

সম্প্রতি নতুন করে এই ঘটনা তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। উঠে আসছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি শেখ হাসিনা ও ভারত জড়িত বলে সংবাদ প্রকাশ করেছে আমার দেশসহ অনেক জাতীয় পত্রিকা।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিরোধী দমনের নগ্ন হাতিয়ার:

২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির অনেক নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।

যদিও এই বিচার প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে , বিরোধী দলগুলো এটি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করে। তাদের দাবি, এই বিচার প্রক্রিয়া আসলে বিরোধী দলকে দমন করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষত, জামায়াতে ইসলামী নেতাদের ফাঁসি কার্যকর করা এবং বিএনপি নেতাদের দমন করার পেছনে ভারতের সমর্থন ছিল বলে তারা দাবি করেন।

এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে এবং বাংলাদেশকে তাদের পরাধীন রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার এই বিচারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।” ভারতের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক দাবিকে ব্যবহার করে বিরোধী দলগুলোর শক্তি নষ্ট করা

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড, ভারতীয় দোসরদের সরাসরি আক্রমণ:

২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে বাংলাদেশের ভারতীয় পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করে। আবরারের অপরাধ ছিল, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত কিছু চুক্তি নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন, এসব চুক্তি একতরফাভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করে এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে।

আবরার তার ফেসবুক পোস্টে ভারতের বিদ্যুৎ করিডোর, নদীর পানি বণ্টন নিয়ে অসম চুক্তি, এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে সমালোচনা করেছিলেন। তার এই বক্তব্য ছাত্রলীগের ক্ষোভের কারণ হয়। তাকে রাতভর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে যে, ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বললে তাকে আওয়ামী লীগ হুমকি হিসেবে দেখত এবং আওয়ামী লীগ ছিল ভারতের স্বার্থের প্রত্যক্ষ পাহারাদার। বিশ্লেষক রাশেদ খান বলেন, “আবরারের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে প্রস্তুত।”

বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন বারবার সরকারের দমননীতি এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বেশ কয়েকবার সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু এই আন্দোলনগুলো সরকারের কঠোর দমননীতির কারণে গণমানুষের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট:

বিরোধী দলগুলোর ভারতীয় দোসর অবৈধ আ’লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সফল আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেও ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ প্রবাহিত হতে থাকে। বিশেষ করে, শিক্ষিত তরুণ সমাজ, যারা রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল না, তারা দেশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, বৈষম্য, এবং ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করে।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলন এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ছাত্রসমাজ, যাদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতি থেকে বিমুখ ছিল, তারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার দাবি নিয়ে একত্রিত হয়। কোটা নিয়ে শুরু হলেও ভারতের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, এবং সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। বিপ্লবীরা তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার বলে স্লোগান দেয়। আরেকটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল “দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা “।

এই আন্দোলনের অনন্য দিক ছিল- এর লক্ষ্য এবং নেতৃত্ব। তরুণ প্রজন্মের এই অভ্যুত্থান কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অধীনে পরিচালিত হয়নি। বরং এটি ছিল সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান মূলত বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের ব্যর্থতার শূন্যস্থান পূরণ করেছিল। ছাত্রসমাজ দেখিয়ে দিয়েছে, যখন রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন তরুণ প্রজন্মই একটি জাতির স্বপ্ন পূরণের পথ দেখায়।

১. বাংলা ব্লকেড ও কমপ্লিট শাটডাউন:

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম কর্মসূচি  ছিল “বাংলা ব্লকেড” এবং “কমপ্লিট শাটডাউন”। বাংলা ব্লকেডের মাধ্যমে দেশের বন্দর, সড়ক, এবং অফিস আদালত বন্ধ করে দেয় ছাত্র জনতা। একইসঙ্গে “কমপ্লিট শাটডাউন” কর্মসূচির আওতায় দেশজুড়ে অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হলেও, সরকারের পক্ষ থেকে দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশি বাধা ও হামলার পরও আন্দোলনকারীরা নিজেদের অবস্থান বজায় রাখে, যা গণমানুষের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়।

আন্দোলনের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রথম “তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার স্লোগান” এবং রংপুরের আবু সাইদের বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে শাহাদাত। তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার স্লোগানের মাধ্যমে মূলত সেদিন ছাত্র জনতা জানিয়ে দিয়েছিল তারা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে আদারিং এর রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে অপশাসনের রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে।

২. ঐতিহাসিক নয়দফা:

১৭ জুলাই যখন সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হয় তখন আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পরে। এই আন্দোলনকে আবার জাগিয়ে তোলে ঢাকা আব্দুল কাদের স্বাক্ষরিত ৯ দফা। ৯ দফা আব্দুল কাদের স্বাক্ষর করলেও এটি লিখেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতিদের একটি টিম; যারা জুলাই বিপ্লবের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের সাথে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন।

৩. ঐতিহাসিক এক দফা ঘোষণা:

৩ আগস্ট ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার নেতা নাহিদ ইসলাম শহিদ মিনারে ঐতিহাসিক এক দফা ঘোষণা করেন, যার মূল দাবি ছিল “বাংলাদেশের সার্বিক স্বাধীনতা, ফ্যাসিবাদি ব্যবস্থার বিলুপ্তি এবং ভারতীয় আধিপত্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠন।” এই ঘোষণার মাধ্যমে তারা দেশের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে।

এই এক দফা আন্দোলন ছিল জনসাধারণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বঞ্চনার প্রতিফলন। ভারতীয় প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশের দাবিতে ছাত্র-জনতার এই ঘোষণা দেশের প্রতিটি স্তরে সাড়া ফেলেছিল। এটি আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে এবং জনগণের ঐক্যকে সুসংহত করে।

৪. পাঁচ আগস্ট বঙ্গভবন জয়:

৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ কোটি ছাত্র-জনতার মিছিল কারফিউ উপেক্ষা করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্যান্টনমেন্ট গণভবনের দিকে যাত্রা করে। সেদিন এদশের মানুষ চুড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। তাদের স্লোগান ছিল মুক্তি অথবা শাহাদাত।

গণভবন জয় ছিল ২০২৪ সালের আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, যা দেশের জনগণকে তাদের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং ভবিষ্যতের জন্য আশার বার্তা দেয়।

২০২৪ এর জুলাই বিপ্লব ভারতীয় আধিপত্য থেকে মুক্তির পথে এক নতুন সূচনা:

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানি শোষণ থেকে মুক্তির জন্য হয়েছিল। তবে, স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে ভারতীয় প্রভাব গভীরভাবে ছায়া ফেলে। বিশেষ করে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের কৌশলগত স্বার্থের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে এসেছে। ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের রাজনীতি এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণতাকে নিশ্চিত করে।

আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আধিপত্য: স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করে। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্কের ধরণ একপাক্ষিক হয়ে ওঠে।

ভারত বাংলাদেশের নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করে, এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে। ট্রানজিট, করিডোর, এবং বন্দর ব্যবহারের সুবিধা নিয়ে ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করা হয়, কিন্তু বাংলাদেশ  সমমানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে।

আওয়ামী লীগ সরকার বারবার এসব চুক্তি এবং কার্যক্রমের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিরোধী দলগুলো এবং নাগরিক সমাজ এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালেও, আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর দমননীতির মাধ্যমে তাদের কণ্ঠরোধ করে।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ভারতের প্রভাবের বিরুদ্ধে একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। ছাত্রসমাজ এবং সাধারণ জনগণের এই আন্দোলন ছিল সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি এবং বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্তি পাওয়ার লড়াই।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ স্পষ্ট করে দেয় যে, তারা আর বিদেশি আধিপত্য মেনে নেবে না। ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, এবং বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করার ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে সরব হয় ছাত্রসমাজ। ৫ আগস্ট বঙ্গভবন জয় এই আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যের মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়

স্বাধীনতার পূর্ণতা:

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তি অর্জন করলেও, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারতীয় প্রভাবের কারণে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২০২৪ সালের আন্দোলন এই শৃঙ্খল ভাঙতে সহায়তা করে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।

বাংলাদেশ এখন এমন একটি পথে হাঁটছে, যেখানে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া স্বাধীনতার লড়াই ২০২৪ সালে পূর্ণতা পায়, যা একটি প্রকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করে।

স্বাধীনতার পূর্ণতায় বাংলাদেশের যাত্রা:

বাংলাদেশের ইতিহাস এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, যা জমিদারি শাসনের শোষণ থেকে শুরু করে পাকিস্তানি অত্যাচার এবং পরবর্তীতে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হওয়ার মাধ্যমে জমিদারদের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়া গেলেও প্রকৃত স্বাধীনতার স্বপ্ন তখনও অধরা ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সেই স্বপ্নকে পূরণ করতে বড় ভূমিকা রাখে, কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় প্রভাবের ছায়া পড়ে।

বিগত দশকগুলোতে ভারতের সঙ্গে অসম চুক্তি, সীমান্তে নাগরিক হত্যা, এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান একটি নতুন যুগের সূচনা করে। এই আন্দোলন শুধু একটি সরকার পতনের ঘটনা নয়; এটি ছিল একটি জাতির নিজের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি।

১৯৭১ সালে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, তা ২০২৪ সালে পূর্ণতা পায়। এটি প্রমাণ করে যে, স্বাধীনতা শুধু ভূখণ্ডের নয়; এটি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং রাজনৈতিক মুক্তির নাম। ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক এক দফা ঘোষণা এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন বাংলাদেশের জনগণকে নিজেদের অধিকার রক্ষায় একত্রিত করেছে।

আজকের বাংলাদেশ একটি নতুন পথে হাঁটছে—একটি পথ যেখানে জাতীয় স্বার্থই প্রধান এবং বিদেশি আধিপত্যের জন্য কোনো স্থান নেই। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের নতুন সূচনা। এই দীর্ঘ সংগ্রাম বাঙালি জাতির ঐক্য, সাহস, এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

তথ্যসূত্র:

১. Majumdar, R. C. (1948). History of Bengal.

২. Hunter, W. W. (n.d.). The Indian Musalmans.

৩. Forster, G. (1905). A Journey Through Bengal.

৪. আনিসুজ্জামান. (১৯৮৫). বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস.

৫. Rahman, M. (1971). Bangladesh Liberation War Documents.

৬.  The Untold Story of East Pakistan.

৭. The Rise of Muslim Identity in East Pakistan.

৮. আনিসুজ্জামান. (১৯৯৫). বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনীতি.

৯. Rahman, A. (1985). The Controversy of National Symbols.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More To Explore

Scroll to Top