বিপ্লব কখন সফল হয়? বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সফলতা কোন পথে?

মো. রুকন উদ্দিন, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Abstract

A revolution succeeds not merely by altering the regime but by transforming the structural foundations of society—politically, economically, and socially. In the context of Bangladesh, the so-called “July Revolution” represents more than just a movement; it embodies a collective yearning for justice, transparency, and equitable governance. This abstract explores the necessary preconditions for a successful revolution, including visionary leadership, mass mobilization, ideological clarity, institutional reform, and sustainable implementation strategies. It argues that the success of Bangladesh’s July Revolution hinges on its ability to translate public discontent into constructive change, foster inclusive national dialogue, and build resilient civic institutions. Ultimately, the revolution’s success will be measured not by regime change, but by its capacity to deliver dignity, rights, and prosperity to the general populace.

ভূমিকা: বিপ্লব সাধারণত একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংঘটিত হয়। যখন কোনো জাতি নিপীড়ন, দুর্নীতি বা শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি একীভূত হয়ে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়, তখন বিপ্লব সফল হয়। তবে সফল বিপ্লব কেবল ক্ষমতার হাতবদল নয়; এটি একটি সুগঠিত আদর্শ ও লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লব যদি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে, তবে এর সফলতা নির্ভর করবে এর আদর্শ, নেতৃত্ব, জনসমর্থন এবং বাস্তবায়ন কৌশলের ওপর। ইতিহাস সাক্ষী যে, শুধু আন্দোলন কিংবা ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, বিপ্লব সফল তখনই হয় যখন তা জনগণের প্রকৃত চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং একটি টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

সুতরাং, বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সফলতা নির্ভর করছে এর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা, গণমানুষের সম্পৃক্ততা এবং একটি সুশৃঙ্খল রূপান্তরের ওপর। এখন প্রশ্ন হলো, এই বিপ্লব কোন পথে সফল হতে পারে? সেটিই হবে আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।

বিপ্লবের তাত্ত্বিক ধারণা:

বিপ্লব শব্দটি সাধারণত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কাঠামোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কারকে নির্দেশ করে। বিপ্লব সাধারণত জনগণের একত্রিত আন্দোলন দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এটি সমাজের গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে।

ইবনে খালদূন (Ibn Khaldun) যিনি ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির একজন অগ্রণী চিন্তাবিদ হিসেবে বিবেচিত; তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ “মুকাদ্দিমাহ” (Muqaddimah), যেখানে তিনি সমাজের উন্নয়ন ও পতনের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। তার বিপ্লব তত্ত্ব মূলত মানব সমাজের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এবং ক্ষমতার উত্থান-পতনের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। তার বিপ্লব তত্ত্বের প্রধান দিক হলো- আসাবিয়াহ (Asabiyyah) বা সামাজিক সংহতি।

ইবনে খালদূন মনে করেন, সমাজ বা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি হলো “আসাবিয়াহ” বা গোষ্ঠীগত সংহতি। (১) একটি গোষ্ঠীর মধ্যে যত বেশি সংহতি থাকবে, তত বেশি তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে। এই সংহতি একটি গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করে তোলে এবং তাদের বিপ্লব বা ক্ষমতা দখলে সফল হতে সাহায্য করে। আমরা ইসলামের ইতিহাসে দেখতে পাই, রাসূল স. এর বয়স যখন ১৮ তখনই তিনি হিলফুল ফুজুল সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যার মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা আরব গোত্রগুলোর মধ্যে ফুজ্জার যুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনিই আবার হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করার মাধ্যমে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধ থেকে গোত্রগুলোকে রক্ষা করেন। রাসূল স. যখন মদিনায় হিজরত করেন তখন মদিনার আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে চলত নিয়মিত যুদ্ধ। তিনি যাওয়ার পরে এই যুদ্ধের স্থানী সমাধান হয়ে যায়। তিনি যে বিপ্লবের ধারণা দেন সেটি হলো ইসলাম। তাঁর বিপ্লবের ধারণা ও ফলাফল হলো- ইসলামই পারে একমাত্র সংঘাত থেকে রক্ষা করে সুন্দর একটি রাষ্ট্র গঠন করতে, নতুন একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।

বিপ্লবের ইসলামী ধারণা:

ইসলামী  আন্দোলনের অন্যতম পুরোদা মোঃ কামরুজ্জামান তার আধুনিক যুগে ইসলামী আন্দোলন বইতে লিখেছেন- ইসলামের সমর্থকদের দ্বারা একটি সরকার গঠিত হলেই ইসলামী বিপ্লব হয়ে যায় না। অতীতে ইসলামের নাম নিয়ে এমন সরকার অনেক দেশে এসেছে কিন্তু ইসলাম সেখানে বাস্তবায়িত হয়নি। হাতে কুরআন আর মুখে ইসলামের শ্লোগান এমন কোন দলের সরকারও ইসলামী বিপ্লবের সরকার নাও হতে পারে।

ইসলামী পণ্ডিত বা আলেমদের দ্বারা গঠিত একটি সরকার ক্ষমতায় এলেই ইসলামী বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে করারও কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। ইসলাম একটি সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতির নাম। অর্থাৎ ইসলামী বিপ্লব একটি সামগ্রিক পরিবর্তন আনয়নকারী বিপ্লবেরই নাম। যে মানুষকে নিয়ে বা যে মানুষের কল্যাণের জন্য বিপ্লব সে মানুষের মধ্যে যদি বিপ্লব বা পরিবর্তন না আসে তাহলে ইসলামী বিপ্লব হতে পারে না। বিপ্লব বলতে অনেকে হঠাৎ বা আকস্মিক পরিবর্তনকে বুঝেন। আকস্মিক পরিবর্তন, বিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ, নৈরাজ্য, সংস্কার, সরকার যন্ত্রের পরিবর্তন বা শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন এসবের কোনটাই ইসলামে বিপ্লব বলে চিহ্নিত বা আখ্যায়িত করা হয়নি। ইসলামে বিপ্লবের ধারণাটাই এসব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা লাভকেই ইসলাম বিপ্লবের জন্য যথেষ্ট মনে করে না। কেননা কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্ব সর্বাবস্থায় আল্লাহর এবং বান্দা সর্বাবস্থায় দায়িত্বশীল বা দায়িত্ব প্রাপ্ত। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা হিসেবে আল্লাহর দেয়া সুযোগ ও ক্ষমতার সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করবে এবং আল্লাহর দাস হিসেবে তার নিজ দায়িত্ব পালন করবে মাত্র।

রাসূল (স.) যে মডেল স্থাপন করেছেন ইসলামী বিপ্লবের মডেল সেটাই। ইসলামী বিপ্লব তো বিপ্লব এ অর্থে যে, এ বিপ্লব মানুষের কাঠামোতে নয় বরং মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, রুচি-দৃষ্টিভংগী, পছন্দ- অপছন্দ অর্থাৎ জীবনের সকল ক্ষেত্রের পরিবর্তন এনে দেয়।

ইসলামী বিপ্লবের অর্থ ইনসাফ, শান্তি, নিরাপত্তা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। অন্য অর্থে আল্লাহর রাজত্ব কায়েম করা। ইসলামের মতে আল্লাহর দুনিয়ায় আল্লাহর রাজ কায়েম হওয়ার এ বিপ্লব এমনিতেই আসে না। অর্থাৎ ইতিহাস এবং বিপ্লব কখনো নিজে নিজেই আসে না।

ব্যক্তিগতভাবে এবং সমষ্টিগতভাবে একটি জনগোষ্ঠী যদি নিজেদের অবস্থার পরিবর্তনে বদ্ধপরিকর হয় তাহলে কেবল মাত্র আল্লাহ সেই জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তন করেন। আসলে মানুষই হচ্ছে ইতিহাসের নির্মাতা এবং পরিবর্তনকারী। জনগণের মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের উপরই নির্ভর করে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন।

সুতরাং ইসলামী বিপ্লব হচ্ছে একটি ব্যাপক, বাস্তব ভিত্তিক, নিরবচ্ছিন্ন, গতিশীল, গভীর বিপ্লব। সেই সাথে এ বিপ্লব হবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, শোষণ-নিপীড়ন ও আধিপত্যবাদ বিরোধী, একনায়কত্ব ও স্বৈরাচার বিরোধী। এ হবে এমন এক সার্বজনীন বিপ্লব যাতে থাকবে আধ্যাত্মিকতা, ইসলামের সঠিক মেজাজ ও প্রকৃতির প্রতিফলন। বিপ্লবের নেতৃত্ব, আবেদন, পথ এবং পন্থা হবে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী এবং আল্লাহর রংয়ের পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটবে এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।

ইসলামের জন্য সংগ্রাম, প্রচেষ্টা, প্রয়াস, সাধনা, খেদমত সবকিছুই ইসলামী আন্দোলন বলে বিবেচিত হলেও বিপ্লব হচ্ছে একটি সামগ্রিক এবং ব্যাপক পরিবর্তনের নাম।

সত্যিকার ইসলামী বিপ্লব তাই যা আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং কর্মসূচীগত- ভাবে পূর্ণতা লাভ করে। ইসলাম বাস্তবায়নের অর্থই হলো জনগণের সার্বিক জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনয়ন। ইসলামী আন্দোলন যেমন শুধু মুসলমানদের জন্য নয় তেমনি ইসলামী বিপ্লবও হচ্ছে গোটা মানবতার বিপ্লব।

অলৌকিক বা আকস্মিকভাবে দুর্ঘটনার মত কি কোন বিপ্লব আসতে পারে? পৃথিবীর ইতিহাস একথাই প্রমাণ করে যে, কোন দেশে বা সমাজে তেমন একটি বিপ্লব হঠাৎ করে সম্পন্ন হতে পারে না।

আমরা ইসলামের ইতিহাসের বিপ্লবের আলোচনায় না গিয়েও দেখি- ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব বা চীনের বিপ্লব হঠাৎ করে আসেনি। ওসব বিপ্লবের পটভূমিকা রচনার পিছনেও আছে বিশাল এবং দীর্ঘ ইতিহাস। সুতরাং প্রয়োজনীয় উপায় উপকরণের সংযোগ না হওয়া পর্যন্ত আকস্মিক কোন বিপ্লবের প্রত্যাশা অর্থহীন। ইরানে ১৯৭৯ সালে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে বাইরের জগতের কাছে এটাকে আকস্মিক ঘটনা বলে মনে হলেও ইরানী জনগণের কাছে যে এটি দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। এ বিপ্লবকে যারা সামান্যও জানার চেষ্টা করেছেন তাদের স্বীকার করতেই হবে যে, অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করেই সম্পন্ন হয়েছে এ বিপ্লব। ইরানে যা হয়েছে ওভাবেই আরেকটি দেশে ঘটবে বিপ্লব এ ধারণা করার কোন কারণ নেই। বিষয়টির গভীরে না গিয়ে এমন আশাবাদ কেউ করতে পারেন। কিন্তু সেই আশাবাদ শেষ পর্যন্ত যে আশাবাদই থেকে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রত্যেকটি দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই নির্ধারণ করবে কোন দেশে কিভাবে বিপ্লব আসতে পারে। নিকট অতীতে (১৫ই আগস্ট-২০২১) আফগানিস্তানে ও সিরিয়ায় (৮ডিসেম্বর-২০২৪) যে বিপ্লব হয়েছে সেক্ষেত্রেও আমাদের একই মূল্যায়ন।

আবার অনেকে মনে করেন, জননন্দিত কোন বীর পুরুষ বা ব্যক্তিত্ব হচ্ছে পরিবর্তন বা বিপ্লবের চালিকাশক্তি। এদের মতে আইন কাঠামো বা বিধিব্যবস্থা হচ্ছে শক্তিশালী বা ক্যারিসম্যাটিক ব্যক্তিত্বের হাতের যন্ত্র মাত্র। তারা যেভাবে চান পরিবর্তন ঠিক সেভাবেই আসে। সাধারণ মানুষের কোন অবদান বিপ্লবে নেই। তাদের কাছে মূল উপাদান হচ্ছে অসাধারণ ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্ব। বলা হয়ে থাকে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’। বীরের বীরত্ব মানুষকে অভিভূত করে। কিন্তু বীর পুরুষের উপস্থিতিই বিপ্লবের কারণ হতে পারে না।

অনেকে এটাও মনে করেন যে, জনগোষ্ঠী বিপ্লবের প্রধান উপকরণ এবং তারাই সামাজিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী। গণতন্ত্রের মতে সর্বোত্তম সরকার ব্যবস্থা তাই যাতে জনগণের অংশীদারিত্ব থাকে। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি গণতন্ত্রও একথা বলেনি যে, সাধারণ জনতাই পরিবর্তন বা বিপ্লবের একমাত্র সিদ্ধান্তকারী শক্তি।

অলৌকিক কিংবা আকস্মিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হতে পারে। এটি অসম্ভব কিছু নয়। তবে তাকে বিপ্লব বলা যাবে না। সেটা ক্ষমতার হাত বদল মাত্র। মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্র ‘সর্বহারাদের বিপ্লবের’ যে ধারণা দেয় ইসলামের নিকট তাও গ্রহণযোগ্য নয়। শক্তিমান সিংহ পুরুষ ডাক দিবেন আর বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যাবে ইসলামে এমন ধারণার অবকাশ নেই। আল্লাহর নবী রসূলদের চাইতে আর কেউ তো সিংহ পুরুষ বা শক্তিমান বা ক্যারিসম্যাটিক হতে পারেন না।

কিন্তু নবী রসূলগণ কি ডাক দিয়েই বিপ্লব সম্পাদিত করেছিলেন? মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ স. চাইতে শক্তিমান পুরুষ বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দুনিয়াতে আর কে হতে পারেন? মক্কাবাসীকে ডাক দেয়ার সাথে সাথেই কি বিপ্লব এসেছে? তাকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সে পথ ছিল সংগ্রামের পথ। যে মানুষের জন্য বিপ্লব চাই সে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনার জন্যে সংগ্রাম করেছেন তিনি। যে রাসূল (স.) বিশ্বের ইতিহাসের সেরা বিপ্লবী সে রাসূলের ভূমিকা ছিল একজন বাণীবাহকের, পথ প্রদর্শকের বা সতর্ককারীর। রাসূল (সা)-এর নেতৃত্বে বিপ্লব এনেছে সেই জনতা যে জনতার কল্যাণের জন্যই এসেছিলেন রাসূল (সা)। ইসলামে নবীর দায়িত্ব হচ্ছে জনগণকে পথ প্রদর্শন ও সত্যের সন্ধান দেয়া। সেই সাথে জনগণকে ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংগঠিত করা, সংঘবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করা। সত্যকে জনগণ গ্রহণ করবে কি বর্জন করবে, এটি তাদেরই সিদ্ধান্ত। সুতরাং দৈবাৎক্রমে কোন কিছু সংঘটিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। যা কিছু ঘটবে তা মানুষের সুনির্দিষ্ট চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যক্রমেরই ফলশ্রুতি।(২)

বিপ্লবের বস্তুবাদী ধারণা:

১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লব বা প্রথম ‘সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ সম্ভব হয়েছিল মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন-সহ অনেক মানুষের তিন ধরনের জ্ঞান চর্চার ফলে।

-প্রথম দফা ছিল  জ্ঞানচর্চা, সমাজ ও জীবন বাস্তবতা নিয়ে, যার দার্শনিক নাম Ontological প্রশ্ন মীমাংসা, গবেষণা, অন্য কথায় আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ, সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি অনুসরণ করে। এই জ্ঞান আসে দর্শন (দ্বন্দ্ববাদ) ও সমাজবিজ্ঞান থেকে। যেমন, লেনিন লিখেছেন ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’, অর্থনীতির দ্বন্দ্বের ইতিহাস বিশ্লেষণ।

-বিপ্লবী তত্ত্বের দ্বিতীয় উৎস ‘মতাদর্শ’। কিছু মূল্যবোধে বিশ্বাস বা আস্থা, যা সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর। যেমন সাম্য, স্বাধীনতা, সহযোগিতা, যত্নশীলতা ইত্যাদি মূল্যবোধ। এটি আসে, কল্পনা, ইমাজিনেশন, ভিশন, বা রূপকল্প থেকে। আগামী সমাজের রূপরেখা, যে সমাজে এই মূল্যবোধগুলো চর্চার বাস্তবতা থাকবে। কাজটি তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নয়, কাজটি ভবিষ্যৎ সমাজের রূপকল্প নিয়ে, যা দাবি করে ‘সৃজনশীলতা’। কল্পনায় আগামী সমাজের ছবি আঁকা, নতুন নামে তা চিত্রিত করা। যেমন, ইউরোপীয় সাম্যবাদীদের রূপকল্প ছিল, ‘সমাজ গণতন্ত্র’, চিনাদের ‘নয়া গণতন্ত্র’। অন্য কথায় ‘সমাজতন্ত্র’।

-বিপ্লবী তত্ত্বের তৃতীয় উৎস আসে কর্মকৌশল বা স্ট্র্যাটেজি, সংগঠন বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞান থেকে। কীভাবে ভিশন বা রূপকল্প বাস্তবে রূপায়িত হবে? কীভাবে ভবিষ্যৎ অর্জন করা হবে? এই প্রশ্নের সমাধান। এই সব জ্ঞানের নির্মাণ না হলে, বিপ্লবী তত্ত্ব অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিপ্লবের জন্য প্রথম শর্ত, বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ। তা না হলে বাস্তব রাজনৈতিক সমাবেশিকরণ হয়ে যায় একটি অন্ধ ও বন্ধ্যা রাজনীতি চর্চা, বিপ্লবী অনুশীলনের নামে, যা পথ হারায় শাসকশ্রেণির রেজিমচেঞ্জের রাজনীতির চোরাগলিতে। (৩)

নিকোলো মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) রাষ্ট্রকে এমনভাবে গঠন করতে চান, যা বিপ্লবের হুমকি সহ্য করতে পারে। তার রাষ্ট্রের চাই ক্ষমতা। তিনি সরকারের কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন বটে, কিন্তু তা ক্ষমতার জন্য, বিপ্লব মোকাবেলার পথ ধরে।

তবে জন মিল্টন (১৬০৮-১৬৭৪) রাষ্ট্রের চরিত্রের চেয়ে সমাজের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। একটি সমাজ তার সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে রাষ্ট্রকে বিপ্লবের মাধ্যমে সাহায্য করবে, তিনি এর পক্ষে ছিলেন। অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য বিপ্লব হলো সমাজের অধিকার, যা জনগণের চাহিদাকে প্রতিফলিত করার জন্য নতুন আদেশ তৈরি করে। ফলে বিপ্লবই স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যম। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের (১৭২৪-১৮০৪) বিচারে বিপ্লব হচ্ছে অগ্রগতির শক্তি। সমাজের জন্য একটি উচ্চতর নৈতিক ভিত্তির উপলব্ধির জন্য বিপ্লব একটি ‘প্রাকৃতিক’ পদক্ষেপ। এ কোনো অস্বাভাবিকতা নয়; বরং স্বাভাবিকতার চাহিদা। কান্টের এই তত্ত্ব ভূমিকা রাখে আমেরিকান ও ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা গঠনে। (৪)

বিশ শতকের বিপ্লবী চিন্তার গঠনে জার্মান দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) ও কার্ল মার্কসের (১৮১৮-১৮৮৩) প্রভাব ছিল প্রখর। হেগেলের কাছে বিপ্লব ছিল মানুষের ভাগ্যের পরিপূর্ণতা। তার তত্ত্বের বিমূর্ততাকে শ্রেণিসংগ্রামের রূপকল্পে খাড়া করেন মার্কস। এখানে লড়াইটা মূলত সমাজের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ ঘিরে। মার্কস প্রস্তাব করেন, মানব ইতিহাসের প্রগতিশীল পর্যায়ের কথা। যার পরিণতি নিশ্চিত হবে শ্রমজীবী মানুষের হাত দিয়ে। সর্বহারাদের দ্বারা উৎপাদনের উপায় দখলের মধ্য দিয়ে, সম্পত্তি-মালিকানাধীন শ্রেণির উৎখাতের মধ্য দিয়ে। মার্কসের বিচারে এটি হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য মানব সংগ্রামের উপসংহার।

পশ্চিমা চিন্তারাজ্য বিপ্লব নিয়ে বিস্তর ভাষ্য নির্মাণ করেছে। বিপ্লবপূর্ব একটি সমাজ কিভাবে বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে থাকে, এর ওপর আলোকপাত করেছেন আমেরিকান ইতিহাসবিদ ক্রেন ব্রিনটন (১৮৯৮-১৯৬৮)। সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার সংমিশ্রণ কিভাবে সমাজের মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান ভাঙনের হাত ধরে এগিয়ে যায় এবং তা কিভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ভাঙন অবধারিত করে, তার ব্যাখ্যা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু একটি সাধারণ ব্যাপার প্রতিটি বিপ্লবেই চোখে পড়ে। তা হলো, শাসক শ্রেণির ক্ষমতাচর্চার প্রতি ক্রমবর্ধমান গণনারাজি আর বিপরীতে ক্ষমতা জারি রাখার জন্য শাসকদের ক্রমবর্ধমান জবরদস্তি। জবরদস্তির ওপর সে অব্যাহতভাবে নির্ভরশীল হতে থাকার ফলে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ ও আতঙ্কিত শাসক শ্রেণি পতন ও বিনাশের দুঃস্বপ্নে অস্থির থাকে। যতই ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত হয়, ততই সে হিংস্র হয়ে ওঠে। সে চায় না বিপ্লব হোক। কিন্তু বিপ্লবের আয়োজনকে সে নিজেই আমন্ত্রণ করতে থাকে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দুর্নীতি জোরদার হয় এবং বিপরীতে বিপ্লবের উপাদানগুলোর উত্থান হতে থাকে।

বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিজের কদাকার চিত্র ও চেহারাকে একসময় আর গোপন রাখতে পারে না। তখন তার বিপরীতে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা গতি লাভ করে। এই গতি ঝড়ের তীব্রতা লাভ করে। কর্তৃত্ববাদী অসহিষ্ণুতাও চরমে পৌঁছে। বিপ্লব তখন তার শক্তি প্রদর্শন করে। সরকারের পতন ঘটে। (৫)

বিপ্লবের তাত্ত্বিক ধারণাগুলি বিভিন্ন দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তার উৎসের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। যেমন:

ইসলামী ইতিহাসে ইসলামের যে বিপ্লবগুলো সংঘটিত হয়েছে, সেখানে বিপ্লবীরা ইসলামকে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাতু সালাম থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ইসলাম পর্যন্ত যুগে যুগে যে সমস্ত বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এ সমস্ত বিপ্লব সংগঠিত হয়েছেছিল আসমানী গ্রন্থকে আইডিওলজি হিসেবে মেনে নিয়ে। ফলে তাঁরা একটি ইনসাফ পূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন।

কার্ল মার্ক্স:

বস্তুবাদী পশ্চিমা দার্শনিকদের মধ্যে মার্ক্স বিপ্লবের তাত্ত্বিক ধারণা সবচেয়ে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইতিহাসের চলাচল মূলত শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। মার্ক্সের মতে, “মজুর” এবং “ধনী শ্রেণি” এর মধ্যে সংঘর্ষের ফলস্বরূপ একদিন সামাজিক পরিবর্তন আসবে, যা “প্রলেতেরিয়েত বিপ্লব” হিসেবে পরিচিত। এটি এক ধরনের শ্রেণিহীন সমাজের দিকে পরিচালিত করবে, যেখানে উৎপাদন উপকরণে সকলের সমান অধিকার থাকবে। মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে, একে “সাম্যবাদী সমাজ” বলা হয়, যেখানে কোন ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য থাকবে না এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা থাকবে জনগণের হাতে।(৬)

আমরা যদি ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি- ইসলাম বলে, ‘সকল মানুষ সমান’ সুতরাং এখানে ধনী গরীবের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না, থাকবে না কোন শ্রেণি বৈষম্য। ধনী তার অধিকার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। সে গরীবকে শোষণ করবে না, গরীবের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। ফলে তারা তাদের স্ব স্ব অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে।

কিন্তু যখনই ধনীরা গরীবকে শোষণ করে, অধিকার হরণ করে তখন বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে।

-এডমন্ড বার্ক: বার্ক বিপ্লবের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। তার মতে, বিপ্লব প্রথা ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে, যার ফলে সমাজে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তিনি ফ্রান্সের বিপ্লবকে সমালোচনা করেছিলেন এবং এটিকে এক ধরনের অরাজকতার ফলস্বরূপ মনে করতেন। (৭)

-অ্যাঙ্গেলস: কার্ল মার্ক্সের সহযোগী ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস, মার্ক্সবাদী তত্ত্বে অবদান রেখেছিলেন এবং বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে আরও সুসংহত করেছিলেন। তিনি জানান, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শ্রেণি সংগ্রামের একটি অংশ, এবং শ্রমিক শ্রেণিকে রাষ্ট্রের বিপরীতে বিপ্লব ঘটাতে হবে। (৮)

বিপ্লবের প্রেক্ষাপট:

বিপ্লব সাধারণত তখনই সংঘটিত হয় যখন জনগণের মধ্যে গভীর অস্থিরতা বা নির্যাতন অনুভূত হয়। শাসক শ্রেণির দ্বারা মানুষ তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, বৈষম্যের স্বীকার হয়। দেশে যখন দূর্নীতি একটি রুটিন কাজে পরিনত হয়। বিপ্লবের প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ার পেছনে  প্রধান বিষয়গুলি হতে পারে:

-অর্থনৈতিক অসাম্য:

যখন ধনী এবং দরিদ্রের মধ্যে আকাশচুম্বী ব্যবধান থাকে, তখন জনগণের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। দেশের সমস্ত সম্পদ গুটিকয়েকজন মানুষ মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। বাজার মূল্য বৃদ্ধি পায়। তখন জনগণের মধ্যে একটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীতে দাবানলে পরিণত হয়। এর ফলে, জনগণ চায় একটি নতুন ব্যবস্থা, যা তাদের মৌলিক অধিকারের প্রতি সন্মান দেখাবে।

-রাজনৈতিক নিপীড়ন:

যদি কোনো সরকার বা শাসকগোষ্ঠী জনসাধারণের অধিকার ও স্বাধীনতা হরণ করে, তবে সে অবস্থায় জনগণ বিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে পারে। যেমন, ফ্রান্সের ১৭৮৯ সালের বিপ্লব এবং রাশিয়ার ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব। রাজনৈতিক নিপীড়ন একটি বড় দিক। যেটি বিপ্লবের প্রক্ষেপট তৈরি করতে ভুমিকা পালন করে। সম্প্রতি যা  আমরা বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের ক্ষেত্রে বা সিরিয়া বিপ্লবের ক্ষেত্রে দেখেছি।

– সামাজিক বা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন:

কখনো কখনো, শিক্ষা, বিজ্ঞান, এবং সংস্কৃতির প্রসারের ফলে জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়, এবং তারা আরও অধিক স্বাধীনতা ও সমতার দাবি করতে থাকে, যা বিপ্লবের জন্ম দেয়।

বিপ্লবের কিছু প্রখ্যাত উদাহরণ:

ইসলামের ইতিহাসে পারস্য বিজয়, রুম বিজয় ইসলামকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছিল। যা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। মক্কা বিজয় ছিল রক্তপাতহীন একটি বিজয়। যার মাধ্যেমে ইসলামকে একটি সুসংহত জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

– ইরানের ইসলামী বিপ্লব ছিল (১৯৭৯) একটি প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্ট রাজতন্ত্রকে উৎখাত করতে কঠোর ভূমিকা রাখে।

– আফগানিস্তানের তালেবানদের বিপ্লব (২০২১) নিকট অতীতের গুরুত্বপূর্ণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ; যেখানে দীর্ঘদিনে পশ্চিমা দখলদারিত্বকে উৎপাটন করে।

– ফ্রান্সের বিপ্লব (১৭৮৯): ফ্রান্সে অভিজাত শ্রেণির নির্যাতন ও জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা দ্বারা উদ্ভূত বিপ্লব, যা আধুনিক গণতন্ত্রের জন্ম দিয়েছে।

– রুশ বিপ্লব (১৯১৭): শ্রমিক ও কৃষকদের নেতৃত্বে রাশিয়ায় ব্যাপক বিপ্লব সংঘটিত হয়, যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা হয় এবং সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়।

– সিরিয়ায় বিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল (ডিসেম্বর-২০২৪) করার ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ জনগণকে বিপ্লবী করে তুলে। ফলে জনগণ বিপ্লবীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিপ্লব:

-বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিপ্লব একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা। কারণ বাংলার মানুষ তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে বেঁচে আছে। বাংলার মানুষ সব সময় নির্যাতিত ছিল। তাই বিপ্লব তাদের নিত্য দিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সাতচল্লিশ। তারপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অতপর চব্বিশের বিপ্লব।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবের ইতিহাস বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ৭১২ সালের ভারত অভিযান থেকে শুরু করতে হবে। সুলতান মাহমুদ (১০০১-১০২৭) টানা সতেরবার ভারত অভিযান চালায়। তারা বাংলার নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার মুক্তিকামী জনগণকে উদ্ধার করেন। এরপর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৩১ সালে সৈয়দ আহমেদ বেরলভি’র নেতৃত্বে বালাকোট আন্দোলন হয়। তিতুমীরের নেতৃত্বে নীলকর বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি আন্দোলন হয়। এই সমস্ত আন্দোলনগুলো বাংলাদেশের বিপ্লবের ইতিহাসকে ব্যাপক করে।

-১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়:

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগ এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাঙালি জনগণের মধ্যে এক নতুন জাতিগত বিপ্লবের ধারণা উন্মোচিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, বাঙালিরা অনুভব করেছিল যে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, এবং রাজনৈতিক অধিকার সঠিকভাবে সম্মানিত হচ্ছে না। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এই দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ফলস্বরূপ ছিল। (৯)

– ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়, তা ছিল একটি জাতিগত, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক বিপ্লব। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়ন, বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা এবং বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি যুদ্ধ ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রলম্বিত সংগ্রাম ছিল একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব, যা বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দেয়।(১০)

-বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান:

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক দলীয় শাসনের মাধ্যমে ফ্যাসীজম প্রতিষ্ঠা করতে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যত্থানের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়, যা ছিল বাংলাদেশে এক ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লব। এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি করে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথে গভীর প্রভাব ফেলে। এর পরপরই, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং একাধিক সামরিক শাসনকাল শুরু হয়। (১১)

 – নব্বইয়ের দশকের গণঅভ্যুত্থান:

১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সামরিক শাসক এরশাদ গণতন্ত্রকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। যার ফলে একটি গণ বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়, যেখানে গণমানুষের আন্দোলন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই ঘটনাও ছিল এক ধরনের বিপ্লব, যা দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের পুনর্গঠন করেছিল।(১২)

বাংলাদেশের বিপ্লবের ইতিহাস শুধু রাজনৈতিক সংগ্রাম বা সরকার পরিবর্তন নয়, বরং এটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিপ্লব, তবে এর আগেও ও পরেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিপ্লবী আন্দোলনের দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব নামে খ্যাত এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব সংগঠিত হয়। স্বৈরশাসক হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৫ বছর বাংলাদেশের উপর বসে থাকা এক শয়তানকে বাংলার ছাত্র-জনতা বিতাড়িত করে গণতন্ত্রকে আবারো শকুনের কালো থাবা থেকে রক্ষা করে।

বিপ্লবের সফলতার দিকসমূহ:

ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার জন্য কিছু  ভিত্তি রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরধা মোঃ কামরুজ্জামান আধুনিক যুগে ইসলামের বিপ্লব বইয়ে লিখেছেন

-ইসলামী বিপ্লবের দুটো প্রধান বৈশিষ্ট্য:

১. ইসলামী বিপ্লবের প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে চিন্তা ও মনোজগতে বিপ্লব এবং পরিবর্তন আনয়ন।

২. দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এই বিপ্লব হবে জনগণের বিপ্লব এবং জনজীবনে আনবে বিপ্লব বা পরিবর্তন। অর্থাৎ ইসলামের মতে জনগণের মানসিক পরিবর্তন এবং জনগণের পরিবর্তনই ইসলামী বিপ্লবের মূল জিনিস।

 -ইসলামী বিপ্লবের ভিত্তি:

তাওহীদ: ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। মানুষের উপর মানুষের কোন ধরনের প্রভুত্ব ও আধিপত্য চলতে পারে না। মানুষ স্বাধীন এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোন শক্তির অধীন নয়। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সর্বময় অধিকারী আল্লাহ, মানুষ নয়।

রিসালাত: মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে এবং সামষ্টিকভাবে আল্লাহর কাছে দায়িত্বশীল এবং পরস্পরের প্রতিও দায়িত্বশীল এবং সমগ্র মানব জাতির প্রতি দায়িত্বশীল। দ্বীন ইসলাম একমাত্র অবতীর্ণ বিধান এবং নবীদের ওহী বা প্রত্যাদেশ দিয়ে পাঠানো হয়েছে এই দায়িত্ব দিয়ে। রিসালাতের মাধ্যমেই পরিপূর্ণ জীবন বিধান ইসলামের চিরন্তন বাণী সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করে পূর্ণতা বিধান করা হয়েছে।

ন্যায় বিচার: মুসলিম ব্যক্তি ও সমষ্টিকে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে এবং বিশ্বজগত, মানবতা, প্রকৃতি এবং এর সম্পদের প্রতি ন্যায় বিচারের সাথে আচরণ করতে হবে।

খিলাফত: মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এবং সৃষ্টি জগতের সেরা। সকল মানুষকে আল্লাহ সম অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন অর্থাৎ মানুষ মাত্রই আল্লাহর নিকট সমান। আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ দুনিয়ায় আল্লাহর আইনের শাসন কায়েম করবে। মুসলমানদের ইসলাম এ শিক্ষাই দেয় যে তারা মানবতাকে খেলাফতের দায়িত্বের পথে পরিচালিত করবে।

ইসলামী বিপ্লব তার নিজস্ব গতিধারায় চলবে। কোথাও এর ব্যর্থতা ইসলামের সামগ্রিক ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত হতে পারে না। কেননা এটা হচ্ছে মুসলিমদের আদি কাল থেকে শুরু হওয়া সব আন্দোলন ও সংগ্রামের একটি সামগ্রিক অব্যাহত প্রক্রিয়া। বর্তমান শতাব্দীতেও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং নতুন গতি লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্বে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে।(১৩)

উইন্ডেল কিং (Wendell King) একজন মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী, যিনি বিপ্লব এবং সামাজিক পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার “The Anatomy of Revolution” (বিপ্লবের শারীরতত্ত্ব) বইয়ে তিনি বিপ্লবের সফলতার উপাদানসমূহ বিশ্লেষণ করেছেন।

কিং-এর মতে, একটি বিপ্লব সফল হতে নিম্নলিখিত উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ:

-সামাজিক অসন্তোষ: জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ এবং বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাস। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া তিনটি বিপ্লব যদি দেখি। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, সিরিয়ার জনগণ দীর্ঘ দিন ধরে তাদেরর সরকার নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। যার ফলে আন্দোলনগুলোতে আমরা জনগণের ইচ্ছুক অংশগ্রহণ দেখেছি।

-সংগঠিত নেতৃত্ব: একটি সুসংগঠিত এবং আদর্শবাদী নেতৃত্ব, যারা জনগণকে সংগঠিত করতে সক্ষম। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সময় আমরা দেখেছি তারা ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে সংগঠিত হয়ে ছিল। যা তাদের সফলতা এনে দেয়।

-বিকল্প আদর্শ: একটি সুস্পষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য বিকল্প আদর্শ বা শাসন ব্যবস্থা, যা জনগণ সমর্থন করতে পারে। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশ ছাত্র-জনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোরও অংশগ্রহণ ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজস্ব আদর্শ ভুলে গিয়ে একটি আদর্শের উপর ভিত্তি করে এই আন্দোলনে এগিয়ে আসে। আর সেটি হলো গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবন।

-সক্ষমতা ও সম্পদ: বিপ্লব পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ এবং সক্ষমতা, যেমন অর্থ, অস্ত্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সময় রেমিটেন্স ফাইটার্সদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তারা বিভিন্নভাবে আন্দোলনে আর্থিক সহায়তা প্রধান করেছেন। সাথে জনগণের অবাধ অংশগ্রহণ ছিল।

-আন্তর্জাতিক সমর্থন: বাইরের দেশগুলোর সমর্থন বা নিরপেক্ষতা, যা বিপ্লবের সাফল্যে সহায়ক হতে পারে। যা আমরা বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সময় দেখেছি। এখানে ছাত্র হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার স্বীকার হয়েছেন। যা পরবর্তীতে আমেরিকা থেকে শুরু করে বিশ্বের অনেক দেশে সহমর্মিতা প্রোগ্রাম হয়ে গেছে বাংলাদেশের ছাত্র জনতার পক্ষে।

এই উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে কিং দেখিয়েছেন কিভাবে বিভিন্ন বিপ্লব সফল হয়েছে বা ব্যর্থ হয়েছে। (১৪)

-জেমস জ্যাসপার (James M. Jasper) একজন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী, যিনি সামাজিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন। তার “The Art of Moral Protest: Culture, Biography, and Creativity in Social Movements” (1997) বইয়ে তিনি সামাজিক আন্দোলনের সাফল্যের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উল্লেখ করেছেন।

জ্যাসপারের মতে, একটি আন্দোলনের সফলতার জন্য নিম্নলিখিত উপাদানগুলো গুরুত্বপূর্ণ:

-সংগঠিত কাঠামো: আন্দোলনের একটি সুসংগঠিত কাঠামো থাকা, যা কার্যকর নেতৃত্ব এবং সমন্বয় নিশ্চিত করে।

-সংস্কৃতি ও পরিচয়: আন্দোলনের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পরিচয় গঠন, যা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সংহতি এবং উদ্দেশ্যের স্পষ্টতা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সময় বিভিন্ন গ্রাফিতি আঁকা হয়। দেয়ালে দেয়ালে এই গ্রাফিতি ছড়িয়ে দেয়া হয়। যা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আন্দোলনকে সফল করতে।

-কৌশল ও কৌশলগত পদ্ধতি: সঠিক কৌশল এবং পদ্ধতি নির্বাচন, যা আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সময় বিভিন্নভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া হয়। যেমন বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট সাটডাউন, চোখে ও মুখে রক্তের চিহ্ন হিসেবে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ জানানো, কফিল মিছিল। সুতরাং এই কৌশলগুলো অপরিহার্য ছিল।

রাজনৈতিক সুযোগ: রাজনৈতিক পরিবেশের সুযোগগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং সেগুলোকে কাজে লাগানো। বৈষম্য বিরুধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে রাজনৈতিক সুযোগ কাজে লাগানো ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যা আন্দোলনকে অনেক বেশি শক্তিশালী করে।

সংবেদনশীলতা ও আবেগ: আন্দোলনের মধ্যে আবেগ এবং নৈতিক মূল্যবোধের উপস্থিতি, যা অংশগ্রহণকারীদের উদ্দীপনা এবং প্রতিশ্রুতি বাড়ায়।

বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের সময় বিভিন্ন স্লোগান, কবিতা আবৃত্তি বিভিন্ন বিপ্লবী গান আন্দোলনকারীকে উদ্দীপনা যোগায়। যা তাদেরকে রাজপথে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে।

এই উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে জ্যাসপার দেখিয়েছেন কিভাবে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন সফল হয়েছে বা ব্যর্থ হয়েছে। (১৫)

বাংলাদেশের জুলাই-আগষ্ট-২০২৪ বিপ্লবের প্রেক্ষিত:

বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লব, যা “জুলাই বিপ্লব” নামে পরিচিত, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই গণ-অভ্যুত্থান মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। (১৬)

ক. জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবের ঐতিহাসিক পটভূমি:

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি পরিপত্র জারি করে, যা ২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ অবৈধ ঘোষণা করে। এই রায়ের পর শিক্ষার্থীরা পুনরায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সরকারের দমন-পীড়নের ফলে এই আন্দোলন অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়, ৫ আগস্ট যা ৩৬ জুলাই নামে বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের অন্তরে ধারণ করেছে। এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ভারতে পলায়নের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। (১৭)

খ. প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা:

জুলাই বিপ্লবের প্রধান প্রভাব ছিল দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সাথে ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদ ধ্বংস করা। এই বিপ্লবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে যে, জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম। এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে।

জুলাই বিপ্লবের সফলতার দিক সমূহ:

জুলাই বিপ্লবের সফলতা নির্ভর করেছে জনগণের ঐক্য, দৃঢ়তা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারের উপর। এই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে দেশের অগ্রযাত্রায় সহায়ক হবে।

জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক, যা প্রমাণ করে যে জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও দৃঢ়তা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম। এই বিপ্লব দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেছে।

-জনসাধারণের সমর্থন:

সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন আন্দোলনকে শক্তিশালী করে, যা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন নিশ্চিত করে।(১৮)

জুলাই আগস্ট  অভ্যুত্থানে শুধুমাত্র ছাত্ররা নয় ছাত্র, জনতা শিক্ষক, কর্মচারী, সবাই এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করায় শেখ হাসিনার পতন হয়। সুতরাং দেশের সমস্ত জনগণ যদি কোন একটি আন্দোলনের যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করে সে আন্দোলনের সফল হয় তার একটি নমুনা সৃষ্টির হলো জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

-নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব: আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটে, যারা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করছেন। (১৯)

-অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন: নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।(২০)

-সংবিধানিক সংস্কার:

স্বতন্ত্র কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়, যাতে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হয়।(২১)

-আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পুনর্গঠন: পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

-অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার: অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন আর্থিক ও বাণিজ্যিক নীতি প্রণয়ন করা হয়।

এই সমাধানসমূহের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের আস্থা পুনর্স্থাপন সম্ভব হয়েছে।

এই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে, যা ভবিষ্যতে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।

-রেমিটেন্স বৃদ্ধি:

জুলাই অভ্যুত্থানের সময় আমরা দেখেছি রেমিটেন্স ফাইটারসরা রেমিট্যান্স পাঠানো  বন্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু ৫ই আগস্টের পরে আমরা দেখেছি রেমিটেন্স এত বেশি আসে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বুঝা দূর হয়। 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব:

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। এই অভ্যুত্থানের আন্তর্জাতিক প্রভাব নিম্নরূপ:

-আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া:

জুলাই অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি গভীর নজর দেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করে। বিশেষ করে, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে।

-কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন:

অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন ঘটে। কিছু দেশ নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেয়, অন্যদিকে কিছু দেশ তাদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে। বিশেষত আধিপত্যবাদী মনোভাব থেকেও কিছু দেশ বের হয়ে এসেছে।

-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মনোযোগ:

বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক সংবাদ প্রচার করে, যা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশ পুনরায় গুরুত্ব পায়।

-আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ:

অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে কিছু আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ও বাণিজ্য অংশীদার তাদের কার্যক্রম পুনর্বিবেচনা করে। তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার ফলে রপ্তানি খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের জুলাই-নভেম্বর সময়কালে রপ্তানি আয় ১৬.১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। (২২)

-আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব:

বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করে। প্রতিবেশী দেশগুলো বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সামঞ্জস্য আনে।

-মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রচার:

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থানকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা আশা প্রকাশ করে যে, এই পরিবর্তন দেশের বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার পথে সহায়ক হবে। (২৩)

বাংলাদেশের জুলাই  অভ্যুত্থানের সফলতা কোন পথে:

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত বিপ্লবটি মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, যা পরবর্তীতে সরকারের পতনের দাবিতে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা নিরস্ত্র অবস্থায় অংশগ্রহণ করে, যা একটি শান্তিপূর্ণ জনবিপ্লব হিসেবে বিবেচিত হয়। (২৪) কিন্তু পূর্ববর্তী বিপ্লবের তাত্ত্বিক পর্যালোচনা থেকে এখন পর্যন্ত এই বিপ্লবকে প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। নিকট ভবিষ্যতে উক্ত বিপ্লব যেসব কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, উক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার মধ্যেই জুলাই বিপ্লবের সফলতা নিহিত।

– রাজনৈতিক অনৈক্য: সরকারের পতনের পর সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হয়, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে সমস্যা তৈরি করে।(২৫) প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাসিস্ট আমলে বসিয়ে রাখা আমলারা সরকারকে সাহায্য করছে না। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রখর আকার ধারণ করেছে। সাথে সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন মুখী হওয়ায় সরকার নানা চাপে থাকায় তার সংস্কার কাজ গুলোও ব্যাহত হচ্ছে।

৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনীতির ‘প্যারাডাইম’-এ বদল ঘটেছে। গত ৫৩ বছরের রাজনীতি ছিল মূলত তিন ধারায় বিভক্ত। প্রধান ধারা বা যেটাকে মূলধারার রাজনীতি বলা হতো, সেটা ছিল ‘প্রহসনের নির্বাচনী রাজনীতি’র ধারা। প্রধানত আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং তাদের সহযোগীদের এ ধারার অন্তর্ভুক্ত ধরা হতো। অন্যদিকে একটা ছিল বাম বিপ্লবী ধারা, আর অন্যটা ইসলামী বিপ্লবী ধারা।

এ তিন ধারার বাইরে অন্য একটি রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছিল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। প্রথমে বিশ্লেষণ আকারে, পরে কর্মসূচি আকারে এবং সর্বশেষ মাঠের রাজনীতি আকারেই এ ধারা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের রাজনীতি’ পরিচয় নিয়ে। এ ধারা যে প্রচলিত তিন ধারার বাইরের একটি নতুন ধারা, সে বিষয়টি এখনও অতটা স্পষ্ট নয়; কারণ প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর অনেকেই বর্তমানে নিজেদের রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষের বা অনেকে নিজেদের এই রাজনীতির প্রবর্তক বলেও দাবি করছে।

খুনি হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে এক দফার প্রথমাংশের বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। এখন বাকি কাজ একটাই; রাষ্ট্র সংস্কার তথা সংবিধান সংস্কার। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা সংবিধান সংস্কারের রাজনীতি গত ৫৩ বছরের চলতি রাজনৈতিক ঘরানার নয়, নতুন ধরনের। সংস্কারের প্রয়োজন আছে– মানুষ এটা অনুভব করছে কিন্তু কতটুকু সংস্কার, কারা, কোন পথে করবে, কোনভাবে করলে সংস্কার টেকসই হবে– এসব নিয়ে দ্বিধা এবং মতপার্থক্য আছে। এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার ঘাটতিও আছে। নির্বাচনের রাজনীতির অভিজ্ঞতা আমাদের যা আছে তা হচ্ছে, একে অপরকে পরাজিত করার জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতা। কিন্তু সংবিধান গ্রহণ কিংবা গৃহীত সংবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে সময়োপযোগী করার যে রাজনীতি, তাতে রাষ্ট্রের সকল অংশের মানুষের সম্মতি পাওয়ার যে রাজনীতি, সকলের মধ্যকার পার্থক্য, ভিন্নমত সত্ত্বেও সকলে সম্মানজনকভাবে বাঁচার, বসবাসের, বিরোধ করবার এবং বিরোধ নিষ্পত্তির পথ পদ্ধতি গ্রহণের যে রাজনীতি, তা সাধারণভাবে একে অপরকে পরাজিত করবার রাজনীতি থেকে আলাদা। এই নতুন রাজনীতি বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় নাই কিন্তু তার প্রয়োজন ভীষণভাবে হাজির হয়েছে। এই নতুন প্রয়োজন মেটানোই এখনকার রাজনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। (২৬)

এখন এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জে রাজনৈতিক দলগুলো এক হতে না পারলে দেশ আবারও আগের জায়গায় ফিরে যাবে। ভারতীয় আগ্রসন থেকে বের হতে পারবে না। সুন্দর রাজনীতির যে আবহ যেটা অধরাই থাকবে। গণতন্ত্র সেটা আবারও বইয়ের পাতায় বা সংবিধানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

-অর্থনৈতিক সংকট: দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ও আন্দোলনের কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে  দুর্নীতি সমস্ত প্রতিষ্ঠানে মারাত্মক আকার ধারণ করে। ব্যাংক খাতকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা প্রখর আকার ধারণ করে। বাজারগুলোতে বিভিন্ন সিন্ডিকেট থাকায় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে  সাধারণ মানুষ কষ্টের দিনাতিপাত করছে। এই অস্থিরতা এখনো কাটিয়ে উঠতে না পার বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি দুর্ভোগ বয়ে আনবে। জুলাই বিপ্লবকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে হলে উক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অতি আবশ্যক।

-সাংবাদিকতা ও প্রচার মাধ্যমের বাধা: ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার অসহযোগিতা এবং কিছু প্রচার মাধ্যমের পক্ষপাতিত্ব আন্দোলনের সঠিক তথ্য প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। (২৭)

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে গণমাধ্যমগুলো যথাযথ সংবাদ পরিবেশন না করার কারণে সরকারের অব্যবস্থাপনাগুলো সাধারণ মানুষের নজরে আসেনি। ফলে দুর্নীতি এবং অসামঞ্জস্য বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ জানতে পারেনি। এবং কিছু গণমাধ্যম ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে নিয়ে সাধারণ ছাত্র জনতার ওপর চলমান গণহত্যা প্রচার করেনি। কিছু কিছু গণমাধ্যম এখনো সঠিক সংবাদ প্রচারে অনীহা দেখাচ্ছে। গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা দেওয়ার পরেও তারা দেশের উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরে জনগণের সামনে উপস্থাপন করছেনা। জুলাই বিপ্লবের সফলতা নিশ্চিত করতে সংবাদ মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে।

-আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সীমান্ত উত্তেজনা: বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিশেষ করে ভারতে এর ছাপ লক্ষ করা যায়। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা। এর পর থেকেই ঢাকা–দিল্লি সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়।

গত ৬ মাসে নানা ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্ক ৫৩ বছরের মধ্যে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এরই মধ্যে নতুন করে সীমান্তে উত্তেজনা শুরু।

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তের দুই কিলোমিটার এলাকায় ভারতের কাঁটাতারের বেড়া, নওগাঁর ধামুইরহাট সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ চেষ্টা, সিলেটের বিয়ানীবাজারের গজুকাটা সীমান্ত এলাকায় ২০০ বছরের পুরোনো মসজিদ পুনর্নির্মাণে বাধা, চলমান উত্তেজনার মধ্যে ভারতের নতুন উস্কানি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বিএসএফের বাঙ্কার নির্মাণ।

একই এলাকায় বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশি আহত হন। (সীমান্ত উত্তেজনা ভারতকে অভ্যুত্থানপুর প্রতি বাস্তবতা মেনে নেয়ার পরামর্শ ইন্ডিপেন্ডেন্স)

এছাড়াও সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের লঙ্ঘন করে সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি করতে চাইছে ভারত।

বিগত ৫৩ বছরে ভারতের বিএসএফ সীমান্তে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু তার কোনটি এখনও বিচার হয়নি। অভ্যুত্থান পরবর্তী সীমান্ত উত্তেজনা একটি অশনি সংকেত। বিভিন্ন বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন  ভারতের সাথে চোখে চোখ রেখে উত্তেজনার সামাল দিতে। পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে কৌশলী ও শক্তিশালী অবস্থান বজায় রাখতে না পারলে জুলাই বিপ্লবের সফলতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। (২৮)

-জাতীয় ঐক্যের সংকট:

অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলেও, পরবর্তী সময়ে এই ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, ৫ আগস্টের ঘটনার পর জাতীয় ঐক্যের ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় ঐক্য শুধুমাত্র নামেই নয়, কার্যকরভাবেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।(২৯) কিন্তু কিন্তু রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক তৎপরতা জাতীয় ঐক্য গঠনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উক্ত সংকট জুলাই বিপ্লবের সফলতাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।

-অভ্যুত্থানপরবর্তী ক্যাম্পাসগুলোতে আবারও টেগিং এর রাজনীতি শুরু হওয়া:

জুলাই আগস্ট অভ্যুত্থানে দেশের ছাত্রসমাজ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সবাই একত্রিত হতে পেরেছিল। কিন্তু অভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের আগের জায়গায় ফিরে গেছে। তারা এখন আবারো টেগিংয়ের রাজনীতি নিয়ে মেতেছে। ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে।  ক্যাম্পাসগুলোতে যে ছাত্রসংসদ আছে তার নির্বাচন হতে দেরি হওয়ায় কিছু  ছাত্র সংগঠন এটার ফায়দা নিচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর কেউ কেউ ক্যাম্পাসের ছাত্রসংসদ যাতে জাতীয় নির্বাচনের পরে হয় সেদিকে জোর দাবি জানাচ্ছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসার আশঙ্কা করছে। জুলাই বিপ্লবের সবচেয়ে শক্তিশালী দাবি ছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না করতে পারলে কম্পাসগুলোতে আগের মত হত্যাকাণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট কে ধ্বংস করে দেবে।

-সংস্কার কমিশনের সংস্কার কাজে ব্যাঘাত:

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের বার্তা ও আকাঙ্ক্ষার বৃদ্ধিতে এবং সর্বজনীন মতৈক্য প্রতিষ্ঠার জন্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের লক্ষ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়।(৩০) পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সংবিধান নির্বাচন পুলিশ প্রশাসন বিচার বিভাগ দুর্নীতি দমন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সহ মোট ১১ টি কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল তারা সংস্কার কাজে সহযোগিতা না করার কথা বলেছেন ফলে অনেক সংস্কার কাজ তার নির্ধারিত গতিতে চলছে না এটা সংস্কার কাজে খুব বেশি ব্যাঘাত করছে যা ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীদের বিচার কাজে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধাগ্রস্ত করছ। গণহত্যাকারীদের বিচার কার্যসম্পন্ন করাও বিপ্লব সফল হওয়ার অন্যতম মাপকাঠ। (৩১)

উক্ত সংকট মোকাবেলায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও সংলাপ জরুরি। সংবিধান সংশোধন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

সর্বোপরি, জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জাতীয় ঐক্যের সংকট দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই সংকট মোকাবেলায় সুসংগঠিত নেতৃত্ব ও কার্যকর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।

পরিশেষে বলা যায় বিপ্লব একটি পরিবর্তনের হাতিয়ার। তবে বিপ্লব পরবর্তী যদি জাতীয় ঐক্য গ্রহণ করা না যায় সেই বিপ্লব সফলতার মুখ দেখতে পারে না। আমরা যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেখি ১৯৬২ সালে পূর্ব জার্মান এবং পশ্চিম জার্মান ভাগ হয়ে যায় বার্লিন ওয়ালের মাধ্যমে। কিন্তু তাদের জাতীয় ঐক্য ১৯৯০ সালে আবার এক জার্মানিতে ঐক্যবদ্ধ করে তুলে। ফলে পৃথিবীতে পরাশক্তিতে  রূপান্তরিত হয়েছে । ঠিক একই ভাবে যদি আমরা দেখি আফগানিস্তানের চিত্রটা ভিন্ন। তারা সুভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ঐক্যবদ্ধ হইতে না পারার কারণে আবারো আমেরিকান আগ্রাসনে পতিত হয়। একইভাবে যদি আমরা দেখি উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া তারা এখনো জাতীয় স্বার্থকে ভুলে গিয়ে একে অপরের  বিরুদ্ধে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দেখা যায়। 

এই তিনটি উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারবো যে, বিপ্লব পরবর্তী জাতীয় ঐক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা আরো একধাপ এগিয়ে বলতে পারি, জাতীয় ঐক্য বিপ্লবকে সফল করে তোলে। ২০২৪ সালের বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান এবং সিরিয়ার অভ্যুত্থানে আমরা জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখেছি। সিরিয়ার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বিপ্লবীদেরকে সিরিয়ার জনগণ যথেষ্ট পরিমাণ সহযোগিতা করেছে। আসাদের পতনের পর আমরা বিপ্লবীদের সাথে জনগণের যে আনন্দ উদযাপন দেখেছি তা থেকে লক্ষ্য করা যায় সিরয়ান জনগণ এই বিপ্লবে  বিদ্রোহীদের পক্ষে ছিল। সুতরাং আমরা বুঝতে পেরেছি যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একটি বিপ্লবকে সফল হতে সাহায্য করে।

আমরা যদি বাংলাদেশের  অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ দেখি বাংলাদেশের যে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে তারা নির্বাচনকে ঘিরে তাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্যে ফাটল দেখা যাচ্ছে এবং সরকারের মধ্যেও সংস্কার করার ক্ষেত্রে খুব শিথিলতা দেখা যাচ্ছে। ফলের জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত আশা হারাচ্ছে। জনগণ যে আশা করছিল স্বৈরসার শাসক পতনের পরে বাংলাদেশ একটি নতুন উদ্যমে নতুনভাবে গড়ে উঠবে। জনগণ যেখানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দলের গণহত্যার বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। তবে আশার কথা হল সংস্কারের কিছু বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে এবং জাতীয় স্বার্থে সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং অন্যান্য প্রেসার গ্রুপ যারা আছে তারা ঐক্যবদ্ধ। আমরা আশা করব বাংলাদেশ এই ফ্যাসিস্ট হাসিনা বা আওয়ামী লীগের বিচারের মাধ্যমে নতুন একটি নজির সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করবে ইনশাআল্লাহ।

তথ্যসূত্র:

১. আল মোকাদ্দিমা ইবনে খালদুন

২. আধুনিক যুগে ইসলামী বিপ্লব মোঃ কামরুজ্জামান

৩. বিপ্লবের ত্বত্ত্ব আসলে কি : আজিজুর রহমান আসাদ ৩ নভেম্বর, ২০২৩, আমাদের সময়.কম

৪. বিপ্লবের তত্ত্ব উপসংহারের দায়ী মুসা আল হাফিজ ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ নয়া দিগন্ত)

৫. বিপ্লবের তত্ত্ব উপসংহারের দায়ী মুসা আল হাফিজ ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ নয়া দিগন্ত)

৬. রেফারেন্স: মার্ক্স, কার্ল. “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” (১৮৪৮)

৭. রেফারেন্স :বার্ক এডমন্ড. “Reflections on the Revolution in France” (১৭৯০)

৮. অ্যাঙ্গেলস, ফ্রেডরিখ. “The Communist Manifesto” (১৮৪৮)

৯. Khaled, Mirza. “The Bangladesh Liberation War.” Pakistan Institute of International Affairs, 2007.

Rahman, Taufiq. “Language and Politics in Pakistan.” Oxford University Press, 2004.

১০. Sisson, Richard, and Leo E. Rose. “War and Secession: Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh.” University of California Press, 1990.

Choudhury, Ghulam Azam. “The Emergence of Bangladesh: The Crisis of 1947.” University Press Limited, 1994.

১১. Alam, Jamil. “Bangladesh Politics and Political Development.” The University Press Limited, 1993.

১২. Riaz, Ali. “Bangladesh: Political and Economic Developments.” Palgrave Macmillan, 2015.

১৩. King, Wendell. The Anatomy of Revolution. New York: Random House, 1965

১৪. Jasper, James M. The Art of Moral Protest: Culture, Biography, and Creativity in Social Movements. Chicago: University of Chicago Press, 1997

১৫. জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ ইতিহাস রচনা বা বাংলাদেশ জুলাই বিপ্লব ঘটনা প্রবাহ অক্টোবর ৩১-২০২৪। ময়নুল ইসলাম শাহ

১৬. জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা এম আর ইসলাম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বাংলা ট্রিবিউন)

১৭. জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা এম আর ইসলাম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বাংলা ট্রিবিউন)

১৮. জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা এম আর ইসলাম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বাংলা ট্রিবিউন)

১৯. Bengali Wikipedia

২০. রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পটভূমিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান

২০২৪ মোহাম্মদ আজম ২১ আগস্ট

২১. জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪ ইতিহাস রচনা বা বাংলাদেশ জুলাই বিপ্লব ঘটনা প্রবাহ অক্টোবর ৩১-২০২৪। ময়নুল ইসলাম শাহ)

২২. ২০২৪ এর সবচেয়ে বড় বিপ্লব এখন যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে ১৬ই নভেম্বর ২০২৪, টিবিএস নিউজ)

২৩. জাতের উদ্দেশ্যে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পুরনো বিবরণ ১৪ই ডিসেম্বর ২০২৪ BSS News

২৪. জুলাই অভ্যুত্থান আসন্ন রাজনৈতিক জটিলতা: ড.মঞ্জুরে খোদা, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ Ajker Patrika

২৫. ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী শেখ হাসিনার শাসনের পতন এবং বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট : আমার বিশ্লেষণ ২৫ আগস্ট ২০২৪  The Both Sider

২৬. ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী শেখ হাসিনার শাসনের পতন এবং বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট : আমার বিশ্লেষণ ২৫ আগস্ট ২০২৪  The Both Sider

২৭. সীমান্ত উত্তেজনা: ভারতকে অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতা মেনে নেয়ার পরামর্শ, রেজায়ানুল হক, ইন্ডিপেন্ডেন্স, ১৩ই জানুয়ারি ২০২৫

২৯. জুলাই অভ্যুত্থান গ্রাফিটি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পদর্শনী: কালের কন্ঠ, বাসর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ Kaler Kantho

৩০.অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক মোড়ের দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ: ডঃ কামাল ২ নভেম্বর ২০২৪ BD Journal

৩১-নির্বাচন ব্যবস্থা বিচার বিভাগ কমিশন গঠনের ঘোষণা, মানবজমিন, ১৫-১-২০২৫ ৩২-সংস্কার কমিশনের কাজ এগোল কতদূর?,বিডিনিউজ, ১৫-১-২৫

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More To Explore

Scroll to Top