প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইসলাম চর্চার গুরুত্ব

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইসলাম চর্চার গুরুত্ব (Importance of practicing Islam of marginalised people)

Abdullah Al Mamun, M.Phil. Islamic University, e-mail: [email protected]..

Abstract

Life and fundamental rights of marginalised people face significant challenges in modern developed world. As a developing country Bangladesh also face this issue alarmingly. Estimates suggest there are at least 30 million marginalized people in Bangladesh. This includes various groups facing social and economic exclusion. These groups experience challenges like limited access to education, healthcare, and job opportunities. While Bangladesh is Muslim-majority, the constitution guarantees freedom of religion. Focusing solely on religious practice might exclude non-Muslims. However, Islamic values like charity (zakat), helping the weak, and treating all with respect (ihsan) can be powerful tools for marginalized communities. By working together based on these values, Muslims and non-Muslims alike can advocate for better education, healthcare, and social justice for all, uplifting their personal, social, and fundamental rights.

ভূমিকা

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলতে সমাজ বা রাষ্ট্রের এমন একটা শ্রেণীকে বুঝায়, যারা সমাজের বা রাষ্ট্রের মূলধারা থেকে বিভিন্নভাবে বিচ্ছিন্ন। শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ বিষয়েই তারা মূলধারা থেকে দূরে অবস্থান করে। এ ধরনের জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।‌ তারা অহরহ নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, ভগ্নস্বাস্থ্য, নিরক্ষরতা তাদের নিত্য সহচর। তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তাদের হিমশিম খেতে হয়।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সৃষ্টির পটভূমি

এদেশে কয়েক শতাব্দীকাল আগে থেকে সামাজিক মান মর্যাদায় বিভেদের ইতিহাস লক্ষণীয়। যার ফলে সমাজে মানুষের মাঝে একাধিক স্তর সর্বযুগেই ছিল। এ পটভূমি বেশ জটিল। বাংলাদেশে সামাজিক স্তরবিন্যাসের মূল প্রোথিত রয়েছে অতীতের ধর্মব্যবস্থা ও আর্থকাঠামোর ভিত্তিতে।[1] অনেক ক্ষেত্রেই পেশা, বৃত্তি বা উৎপাদন ব্যবস্থাই সামাজিক স্তরবিন্যাসকে ধর্মরূপের মধ্যে স্থায়িত্ব প্রদান করেছে। বাংলার হিন্দুসমাজ বর্ণভেদ প্রথার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে দুটি মধ্যবর্তী বর্ণ-ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য তেমন দৃশ্যমান ছিল না। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যেমন ভৌগোলিক বিভাজন ছিল (রাঢ় এবং বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ), তেমনি কৈবর্ত ব্রাহ্মণ নামে আরও একটি স্তর ছিল।[2]  

অব্রাহ্মণ উপ-শ্রেণিকে সাধারণত পৌরোহিত্য সংক্রান্ত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: উচ্চ মিশ্র, মধ্যম মিশ্র এবং নিম্নশ্রেণির মিশ্র। প্রথম শ্রেণিতে করণ বা কায়স্থ (লেখক), অম্বষ্ঠ বা বৈদ্য (ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসক), এছাড়া তাঁতি, উগ্র (যোদ্ধা) এবং অন্যান্যদের মধ্যে কুড়িটি উপবর্ণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্বর্ণকার, ধীবর (জেলে) প্রমুখ বারোটি উপবর্ণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবং সর্বশেষ শ্রেণিতে চন্ডাল (মৃতদেহ সৎকারকারী ব্যক্তি), চামার (মুচি) ও অন্যান্যদের মধ্যে নয়টি উপবর্ণের লোকজন অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেষোক্ত শ্রেণিটি ছিল অস্পৃশ্য শ্রেণি।[3]

কিছু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসক প্রথমবারের মতো উল্লেখ করেন যে ভারতে মুসলমানদের সামাজিক স্তরবিন্যাস হিন্দু বর্ণপ্রথার অনুসরণে করা হয়েছিল। তিনটি প্রধান স্তরের মধ্যে ছিল আশরাফ বা উচ্চ শ্রেণির মুসলমান, আজলাফ বা নিম্ন শ্রেণির মুসলমান এবং আরজল বা মানমর্যাদাহীন শ্রেণির মুসলমান। প্রথম গুচ্ছে ছিল সৈয়দ, শেখ, পাঠান এবং মুগল পক্ষান্তরে অন্য দুটি গুচ্ছে পঞ্চাশটির মতো পেশাজীবী বর্ণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটা লক্ষণীয় যে, মুসলমানদের মধ্যে আন্তঃর্বিবাহ বা আন্তঃবর্ণ বিবাহের প্রচলন ছিল, কিন্তু হিন্দুদের মত শুদ্ধতা-অশুদ্ধতা বা একত্র আহার সংক্রান্ত বিধিনিষেধের দিকগুলি অনুসরণ করা হতো না। বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে উচ্চবর্ণের উপস্থিতির বিষয়টি ভারতের উত্তরাঞ্চলের তুলনায় অনেক কমই গুরুত্ব বহন করত। এ সকল বিভেদ এখানে কম ছিল বলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে বর্ণবিভেদ খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।[4]

কেউ কেউ বিশ্বাস করত বাংলার মুসলমানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্য থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, এসব কারণে দ্রুত ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারেনি। মুসলমানদের সামাজিক স্তরবিন্যাসের বাধ্যবাধকতার বাঁধন নমনীয় হওয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এই যে, বর্ণসমূহের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক অনেকটা সহজ ছিল। একজন নিম্নবর্ণের মুসলমানের পক্ষে উচ্চ অবস্থানে উন্নীত হওয়া সম্ভবপর ছিল। এ ধরনের অবস্থানের পরিবর্তন বাংলাদেশে ত্বরান্বিত হয় ধনসম্পদ অর্জনের কারণে।[5] মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক স্তরবিন্যাসের এ ধরনের নমনীয় প্রক্রিয়াটি একটি পৃথক আদর্শগত পরিপ্রেক্ষিত থেকে এর উপাদান সংগ্রহ করে, যা ‘শরাফতি’ বলে পরিচিত। এটা একজন মানুষের মহৎ পরিচিতি থেকে পরোক্ষভাবে এসেছে। হিন্দু বর্ণপ্রথার মতো কোন গভীর ধর্মীয় আদর্শের চেয়ে বরং কারও বংশগত পরিবারের ওপর এটা অধিকাংশে নির্ভরশীল ছিল।[6]

সামাজিক স্তরবিন্যাসের নির্মাণে প্রাথমিক পর্যায় থেকে কৃষিকাঠামো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা পর্যায়ক্রমে বর্তমান আকারে রূপ নেয়। একটি ছোট শহরের জনগোষ্ঠীর বিপরীতে জনসংখ্যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গ্রামাঞ্চলে বাস করত। যারা গ্রামে বসবাস করত তারা কৃষি থেকেই জীবিকা নির্বাহ করত। অতএব কৃষিকাঠামো থেকে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। জমিদার শ্রেণির নিচেই ছিল একটা বিশাল কৃষক শ্রেণি। পর্যায়ক্রমিক ঔপনিবেশিক আমল, বিশেষত উপ-সামন্তপ্রথার (যা বাংলায় ‘পত্তনধারী’ বলে পরিচিত) সময়কার ভূমিনীতি একটা মধ্যবর্তী খাজনা সংগ্রাহক ব্যবস্থার সৃষ্টি করে, যার ফলে জোতদার, গণতিদার, হাওলাদার বা তালুকদার কিংবা ভূঁইয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের কৃষিনির্ভর স্তরের অভ্যুদয় ঘটে।[7]

সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণে পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াটি কালক্রমে তার গুরুত্ব সম্পূর্ণভাবেই হারিয়ে ফেলে। কৃষির পুঁজিবাদী বিকাশ এবং সীমিত শিল্পায়ন সত্ত্বেও পাকিস্তান আমলে পুঁজিবাদী উন্নয়ন একটি স্বতন্ত্র শ্রেণির বিকাশ সংঘটনে যথেষ্ট ছিল না। পরাধীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সব সময়েই একটি পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অভ্যুদয়কে ব্যাহত করে, যে ধরনের অভ্যুদয় শিল্পায়িত পাশ্চাত্য বুর্জোয়া, উচ্চ শ্রেণির ভদ্রলোক ও পেশাজীবীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তার বদলে রাজনৈতিক, অর্থনীতির পরিভাষায় দালাল বুর্জোয়া, প্রতিনিধিত্বমূলক মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং উদ্বাস্ত্ত শ্রেণি শহর এলাকায় সামাজিক শূন্য স্থানসমূহ দখল করে ফেলে।

সার্বিকভাবে একথা সত্য যে, দুর্বল শিল্পায়ন ও নিরক্ষরতা এবং দারিদ্র্য বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার মূল চিত্র, তথাপি পুরানো সমাজকাঠামো থেকে আধুনিকতার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার উত্তরণমূলক প্রক্রিয়াও ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। এর ফলে জনসমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনগ্রসরতা ও প্রান্তিকতার শিকার হচ্ছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিচয়

আভিধানিক অর্থে প্রান্তিক বলতে বুঝায় প্রান্ত সম্বন্ধীয়, প্রান্তে অবস্থিত, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুই শ্রেণির প্রান্তে বা সীমায় অবস্থিত ইত্যাদি।[8] ইংরেজিতে এর প্রতিশব্দ Marginalized ব্যবহৃত হয়। শব্দটি প্রথম ব্যবহারে আসে ১৯৬৮ সালে।[9] পারিভাষিকভাবে প্রান্তিক কথাটি একাধিক অর্থ প্রকাশ করে। একটি দেশের জনগোষ্ঠীদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কোন ক্ষেত্র বিবেচনায় সে ক্ষেত্রের সীমানায় অবস্থানকারী অর্থাৎ সাধারণ শ্রেণি থেকে ভিন্ন অবস্থানে থাকা জনগোষ্ঠী। ক্ষেত্রের ভিন্নতায় প্রান্তিকতার সংজ্ঞাও ভিন্ন হয়। যেমন-

  1. জাতিগতভাবে প্রান্তিক ( যারা মিশ্র বিবাহের বংশধর, কিংবা অভিবাসী)।
  2. জৈবিক বিবেচনায় প্রান্তিক (যারা শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, সমাজের মনোযোগ এবং যত্ন থেকে বঞ্চিত)।
  3. বয়সের সাথে সম্পর্কিত প্রান্তিক (বয়সের দিক থেকে এমন একটি প্রজন্ম যাদের সাথে সমাজের মূল শ্রেণির যোগাযোগ একপ্রকার বিচ্ছিন্ন বলা চলে)।
  4. সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে প্রান্তিক (যারা জীবনযাত্রা, পেশা ইত্যাদির কারণে অন্য সামাজিক কাঠামোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারেনা)।
  5. অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক (বেকার এবং দরিদ্রতম)।
  6. রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক (যারা ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তাধারার ফলে ভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রামের পদ্ধতি ব্যবহার করেন, তারা সাধারণত সমাজে গৃহীত হন না)।
  7. ধর্মীয়ভাবে প্রান্তিক (ভিন্ন কিংবা ভ্রান্ত বিশ্বাসের ফলে সমাজের মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন)
  8. অপরাধী প্রান্তিক (সভ্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যারা অপরাধী, তারাও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার ফলে প্রান্তিক হিসেবেই বিবেচিত)।

মোটকথা, প্রান্তিক বলতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান থেকে বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মূলত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজসেবা অধিদফতরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষ কিছু নিম্ন আয়ের কিছু পেশার অধিকারী জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তারা হলো-

  1. কামার
  2. কুমার
  3. নাপিত
  4. তাঁতি
  5. বাঁশ ও বেত প্রস্তুতকারী
  6. কাশা/পিতল প্রস্তুতকারী
  7. নকশী কাঁথা প্রস্তুতকারী
  8. জুতা মেরামতকারী ও
  9. অন্যান্য লোকশিল্পের সাথে জড়িত জনগোষ্ঠী।

এছাড়াও মজুর শ্রেণি, প্রান্তিক চাষী, জোলা, বারুই, স্বর্ণকার, মউয়াল, কুলু, সাপুড়ে, রিকশা চালক, আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বেদে সম্প্রদায়, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও প্রান্তিকতার সংজ্ঞাভুক্ত।

জনবৈচিত্র্যের এই দেশে বৃহত্তম বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও ৪৫টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। পাহাড় সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। তারা বেশির ভাগই ভূমিহীন, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এসব প্রান্তিক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করে। বৃহত্তর ময়মনসিংহে—গারো, কোচ, বানাই, ঢালু, হাদি ও বর্মণ জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে—চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চংগ্যা, ম্রো, লুসাই, বোম, পাংখো জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। উত্তর বঙ্গে—সাঁওতাল, মুণ্ডা, মাহাতো, ওঁরাং, মালো, পাহান, সিং, মাহালি, পাহাড়িয়া বসবাস করছে। কক্সবাজারে রাখাইন এবং সিলেটে গারো ও খাসিয়া উপজাতি বসবাস করছে।[10]

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পিছিয়ে পড়া ৯ পেশার ৫৩ লাখ প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা নিরূপণ করেছে। তাদের মধ্যে বেদে ৬৯ হাজার ২১ জন, কুমার এক লাখ ৫১ হাজার ৫৯৮ জন, জেলে ৩১ লাখ ৯ হাজার ৯৯৩ জন, কামার এক লাখ ৩৮ হাজার ১৯৩ জন, স্বর্ণকার এক লাখ ৮৯ হাজার ৯৬২ জন, বাঁশ-বেতের কাজ তিন লাখ ৩২ হাজার ৯৯২ জন, কাঠমিস্ত্রি সাত লাখ ২৫ হাজার ৬০১ জন, মিষ্টি প্রস্তুতকারক দুই লাখ ২০ হাজার ৭০০ জন এবং নাপিত তিন লাখ ৩০ হাজার ৪৮০ জন। আবার পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৪৩টি। যেখানে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজার।[11]

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের অধিকাংশ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের ন্যুনতম সামাজিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে ইসলাম চর্চার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকার একজন ব্যক্তির মর্যাদা ও আত্মসম্মানের সাথে জড়িত একটি বিষয়, যা মানুষ্য সমাজের নৈতিক মানদণ্ডকে প্রকাশ করে। এটি কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নয় বরং গোটা বিশ্ব সমাজের মান মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। কাজেই মানবাধিকার সমুন্নত রাখার দায়িত্ব ব্যক্তির তো বটেই, বিশ্ব সমাজেরও। এর বাস্তবায়ন ইসলাম চর্চার মধ্য দিয়েই সম্ভব।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইসলাম চর্চার গুরুত্ব

অধিকার প্রতিষ্ঠায়

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে কালজয়ী চিরন্তন আদর্শ হিসেবে একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই সকল যুগে মানবাধিকার সুনিশ্চিত করেছে। অসীম জ্ঞানময় নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান ইসলামই মানবাধিকার নিশ্চয়তার গ্যারান্টি। আজকের বিশ্বে মানবাধিকারের যথার্থ বাস্তবায়নের জন্য ইসলামের বিকল্প নেই। ইসলামে জীবন দর্শন যেমনি পরিপূর্ণ, ইসলামে মানবাধিকার ধারণাও তেমনি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ।

জীবনের নিরাপত্তার অধিকার

মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষের বেঁচে থাকার তথা জীবনের নিরাপত্তার অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। ইসলাম আদালতে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ও আদালত কর্তৃক শাস্তি ঘোষণা ব্যতীত কোনো মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করাকে সমস্ত মানবকুলের হত্যার সমতুল্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করল অথবা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল, সে যেন সমস্ত মানবমণ্ডলীকে হত্যা করল।’

অমুসলিমের ধর্ম পালনের অধিকার

ইসলামী রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের লোক স্বাধীন ও নিরাপদ বসবাস করার এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম প্রত্যেক ধর্মের উপাস্যদের নিন্দাবাদ ও গালমন্দ করাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহকে ব্যতীত অন্যকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না।

নারীর মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার

প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারীর মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করেছে। মায়ের পদ তলে সন্তানের জান্নাত ঘোষণা দিয়ে নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। হাদিসে উল্লেখিত যে, জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নালোকে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম তিনবার মায়ের সেবা করার কথা বলেছেন, অতঃপর চতুর্থ বারে পিতার সেবা করার কথা বলেছেন। আল কোরআনে নারী-পুরুষ একে অপরের পোশাক বলে মন্তব্য করেছেন। ইসলাম প্রতিটা কন্যা সন্তানকে এক একটা জান্নাত বলে অভিহিত করেছে। ইসলাম নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে তা বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল।

ন্যায্য বিচার প্রাপ্তির অধিকার

ইসলাম ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের সুবিচার প্রাপ্তি এবং আইনের দৃষ্টিতে সমতার বিধান আরোপ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করো, এটা তাকওয়ার নিকটবর্তী।’ (আল-কোরআন)। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, পানি সেচ দেওয়া নিয়ে এক মুসলিম ও বিধর্মীর সাথে ঝগড়ার সৃষ্টি হলে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঐ বিধর্মীর পক্ষে বিচারের রায় দেন। ফলে মুসলিম ব্যক্তিটি নাখোশ হয়ে হজরত ওমর (রা.)-এর নিকট আপিল করলে হজরত ওমর অপরাধী মুসলিম ব্যক্তির গর্দান বিচ্ছিন্ন করে দেন। এই বিচার ব্যবস্থা দ্বিতীয়টি আজো দেখা যায়নি।

শ্রমিকের অধিকার

ইসলাম শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সোচ্চার। শ্রমিক যেন তার প্রাপ্য অধিকার যথাযথ পায় এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ মালিক ও শ্রমিকের মাঝে কোনোরূপ বৈরতা সৃষ্টি হতে দেয়নি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, শ্রমিকেরা তোমাদের ভাই, তোমরা যা খাবে তাদেরও তাই খেতে দিবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তাই পরতে দেবে।

মতামত প্রকাশের অধিকার

নির্বিঘ্নে সত্য ও স্বাধীন মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার ইসলামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্য গোপন করে মিথ্যা প্রকাশের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করাকে সর্বোত্তম জিহাদ বলে ঘোষণা দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি সত্য ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বিরুদ্ধবাদীদের হাতে নিহত হওয়াকে শহীদ বলে ঘোষিত হয়েছে।

দুস্থ-অসহায়ের অধিকার

দুস্থ-অসহায় মানুষের জীবন মান সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ধনীদের সম্পদে গরিবের হক প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যম ইসলাম সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে।মানবতার কল্যাণকামী জীবন ব্যবস্থা ইসলাম। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধন এ জীবন ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য। ইসলাম মানবতার সকল অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বদা সরব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেক হকদারের প্রাপ্য হক আদায় করে দাও।’ প্রাচীন ও আধুনিক কোনো ইতিহাসই এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থা দেখেনি, যা ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীদের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন করেছে।

ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্মীয় ব্যবস্থাই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার আদায়ে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ইসলাম পিতামাতা, ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষকে পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করে তাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনুরূপ ভাবে ইসলাম শ্রেণিগতভাবে মুসলমান ও অমুসলিমের উল্লেখ করে সকল শ্রেণি ও ধর্মের অধিকার দিয়েছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, একমাত্র ইসলামই মানবাধিকারের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আর্থিক উন্নয়নে

সম্পদ মানবজীবনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য সম্পদের প্রয়োজন। আল্লাহ মানুষের ভেতর সম্পদের ভালোবাসা দান করেছেন, যেন সে জীবনের জন্য অপরিহার্য ও প্রয়োজনীয় সম্পদ উপার্জনে আগ্রহী হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের কাছে সুশোভিত করা হয়েছে।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৪)।

তবে ইসলাম সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হতে নিষেধ করে, যা মানুষের ভেতর অপরাধপ্রবণতা তৈরি করে। ইসলাম মানুষকে আর্থিক জীবনে ভারসাম্য রক্ষা ও কল্যাণকামী হওয়ার শিক্ষা দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ও শিক্ষায় আছে সেই কল্যাণ-অর্থনীতির নির্দেশনা।

জীবনের বিভিন্ন স্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) একাধিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। শৈশব ও কৈশোরের পশু চরানোর মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর আর্থিক কর্মকাণ্ড এবং পরিণত বয়সে তিনি খাদিজা (রা.)-এর বাণিজ্য-প্রতিনিধি হয়ে সিরিয়ায় গমন করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘এমন কোনো নবী প্রেরিত হননি, যিনি বকরি চরাননি।’ সাহাবিরা বললেন, আপনিও? তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি কয়েক কিরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীর পশু চরাতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৬২)

মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) মদিনার মুসলিমদের জন্য বাজার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারসাম্যপূর্ণ এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, যা মদিনার মুহাজিরদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, আনসার সাহাবিদের কৃষিনির্ভরতা কমাতে সাহায্য করে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ইহুদিদের প্রভাব হ্রাস করে।

আর্থিক উন্নয়নে রাসূল (সা:) এর কর্মসূচী ও নির্দেশনা

মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) মদিনায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতির ‘মডেল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাফল্যের পেছনে ছিল আল্লাহর নির্দেশনা ও অনুগ্রহ এবং তাঁর দূরদর্শী কিছু সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এমন পাঁচটি কর্মসূচির বর্ণনা তুলে ধরা হলো-

  1. মদিনায় কল্যাণ-অর্থনীতির প্রবর্তন : ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে কল্যাণ-অর্থনীতির প্রবর্তন করেন। যে অর্থনীতির ভিত্তি ছিল ঈমান ও সামাজিক সাম্য। ঈমানের কারণে মুসলিমরা তাদের অর্থনৈতিক জীবনে পরকালীন জবাবদিহি ও মুক্তিকে প্রাধান্য দিত। এবং সামাজিক সাম্যের কারণে মুসলিম সহমর্মিতার ভিত্তিতে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিত। মদিনার আনসার ও মুহাজির, ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ভ্রাতৃবন্ধন স্থাপন ছিল মহানবী (সা.)-এর একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ। এই উদ্যোগের প্রতিবাদ্যই ছিল পার্থিব প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সামগ্রিক সংকট দূর করা।
  2. অর্থনীতির নৈতিক ভিত্তি দান : রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামী অর্থনীতির একটি নৈতিক ভিত্তি দাঁড় করান, যেন মানুষ নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে অর্থোপার্জনের পেছনে না ছোটে এবং ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে মানবকল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের (হাশর হবে) নবী, সিদ্দিক ও শহীদের সঙ্গে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১২০৯)
  3. সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি : যারা অর্থ উপার্জন করে বা অর্থের মালিক হয়, ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা আছে। এই সামাজিক দায়িত্ব আদায়ে ইসলাম জাকাত, সদকা, কাফফারার মতো বিধানের প্রবর্তন করেছে। ধনীদের মানবিক কাজে অর্থ ব্যয়ের নির্দেশ প্রদান করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আত্মীয়-স্বজনকে দেবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় কোরো না।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬)
  4. জনস্বার্থকে প্রাধান্য দান : ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মুনাফার চেয়ে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। ফলে জনস্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে—এমন অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কোরো এবং নিজ হাতে নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনো না। তোমরা সৎকাজ কোরো, আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৫)
  5. সম্পদ সংরক্ষণ : সম্পদ ধ্বংস হয় এমন সব কাজ থেকে আল্লাহ বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের সম্পদ, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য উপজীবিকা করেছেন, তা নির্বোধ মালিকদের হাতে অর্পণ কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫)।

শিক্ষা ও নৈতিকতার উন্নয়নে

নৈতিক শিক্ষা ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির অন্তর্গত। ইসলামি দর্শনে আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনোই জ্ঞান নেই; নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’সুরা বাকারা, আয়াত: ৩২

আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল: ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানব ‘আলাক’ হতে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে যা তারা জানত না।’সুরা আলাক, আয়াত: ১-৫ ‘দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণ শেখালেন।’সুরা রহমান, আয়াত ১-৪

নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব

আচরণে (আমলে বা কর্মে) ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে যেসব বিষয় সরাসরি সম্পর্কিত সেগুলো হলো সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। আচরণে অভীষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর এক প্রশ্নের জবাবে হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘ইলম হলো তিনটি বিষয়—আয়াতে মুহকামাহ (কোরআন), প্রতিষ্ঠিত সুন্নত (হাদিস) ও ন্যায় বিধান (ফিকাহ)।’তিরমিজি

হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘(শিক্ষিত তিনি) যিনি শিক্ষা অনুযায়ী কর্ম করেন (অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষাও থাকে)।’ (সহিহ তিরমিজি ও সুনানে আবু দাউদ)। ইলম বা জ্ঞান হলো মালুমাত বা ইত্তিলাআত তথা তথ্যাবলি। এটি দুভাবে অর্জিত হতে পারে: (ক) পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা। যথা (১) চক্ষু, (২) কর্ণ, (৩) নাসিকা, (৪) জিহ্বা ও (৫) ত্বক। এ প্রকার ইলমকে ইলমে কাছবি বা অর্জিত জ্ঞান বলে। (খ) ওয়াহি। যথা (১) কোরআন ও (২) হাদিস। এ প্রকার ইলমকে ইলমুল ওয়াহি বা ওয়াহির জ্ঞান বলে।

নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে কোরআনের নির্দেশনা

হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করলেন: ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের মাঝে পাঠান এমন রাসুল, যিনি আপনার আয়াত উপস্থাপন করবেন, কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ও কৌশলী।’সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৯ মানুষ দোষে-গুণে সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাতে ঢেলে দিলেন অপরাধপ্রবণতা ও তাকওয়া। অবশ্যই সফল হলো সে যে তা পবিত্র করল; আর বিপদগ্রস্ত হলো সে যে তা ছেড়ে দিল।’সুরা শামছ, আয়াত: ৮-১০। ‘নিশ্চয় যারা অকৃতজ্ঞ, হোক সে কিতাবধারী ও অংশীবাদী, সে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল দগ্ধ হবে; তারাই সৃষ্টির নিকৃষ্টতম। আর যারা বিশ্বাসী ও সৎ কর্ম করে, তারাই সৃষ্টির সেরা।’সুরা বাইয়িনা, আয়াত: ৬-৭

নৈতিক শিক্ষা সম্বন্ধে হাদীসের নির্দেশনা

হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা (মুদগাহ) আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব।’বুখারি শরিফ, হাদিস: ৫০

ব্যক্তির অর্জনীয় উত্তম বৈশিষ্ট্য বা সদ্‌গুণাবলি

আত্মিক ও মানবিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন সদ্‌গুণাবলি অর্জন ও ষড়্‌রিপু নিয়ন্ত্রণ। সদ্‌গুণাবলির মধ্যে আছে কৌমার্য, সতীত্ব, শক্তিমত্তা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বোধ, দয়া, মহানুভবতা, পরোপকারিতা, ধৈর্য-সহনশীলতা, মিতাচার বা সংযম ইত্যাদি। ধর্মীয় সদ্‌গুণ তিনটি; যথা (১) বিশ্বাস, (২) আশা ও (৩) ভালোবাসা।

বর্জনীয় ও নিন্দনীয় বিষয়সমূহ

বর্জনীয় বিষয় হলো ষড়্‌রিপু বা কুপ্রবৃত্তিসমূহ। যথা (১) কাম, (২) ক্রোধ, (৩) লোভ, (৪) মোহ, (৫) মদ, (৬) মাৎসর্য। সাধারণত মানুষের মধ্যে ১০টি সদ্‌গুণ ও ১০টি বদগুণ বিদ্যমান থাকে। মানুষের উচিত বদগুণ বর্জন ও সদ্‌গুণ অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জন করা। এ ছাড়া কিছু উত্তম বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অর্জন করা মানুষের জন্য বাঞ্ছনীয় ও প্রশংসনীয় এবং কল্যাণের পথে সহায়ক।

বিদ্যা মানে জ্ঞান, শিক্ষা মানে আচরণে পরিবর্তন। সব শিক্ষাই বিদ্যা কিন্তু সব বিদ্যা শিক্ষা নয়; যদি তা কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা না হয়। জ্ঞান যেকোনো মাধ্যমেই অর্জন করা যায়, অধ্যয়ন জ্ঞানার্জনের একটি পন্থা মাত্র। অধ্যয়ন মানে পঠন বা পাঠ করা অথবা পাঠ গ্রহণ করা; অধ্যাপনা মানে পাঠন বা পাঠদান বা পাঠ প্রদান করা। অধ্যয়ন সব সময় জ্ঞানার্জনের সমার্থক নয়; জ্ঞানার্জন সর্বদাই অধ্যয়নের সমার্থক হয়। বর্তমানে বস্তুবাদী শিক্ষা ও আর্থসামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের সমাজকে করেছে কলুষিত, জাতিকে করেছে কলঙ্কিত, দেশকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ।

নৈতিক শিক্ষায় পিতা, মাতা ও অভিভাবকের করণীয়

শিশুর বা সন্তানের নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান উৎস হলেন তার পিতা, মাতা ও অভিভাবকেরা। তাঁদের জীবন ও কর্ম পৌষ্য বা সন্তানের জীবনে সরাসরি প্রতিফলিত হয়। তাঁরা যদি সৎ ও সুন্দর পরিশীলিত চরিত্র ও মার্জিত আচরণের অধিকারী হন, সন্তানেরা দেখে দেখেই তা আয়ত্ত করবে। সন্তানেরা তাঁদেরই প্রতিবিম্ব।

নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষকের করণীয়

শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধান প্রভাবক। শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক হলেন হিরো (নায়ক) বা আইকন (মডেল)। তাই শিক্ষককে হতে হবে শিক্ষার্থীর রোল মডেল বা আদর্শের বাস্তব নমুনা।

নৈতিক শিক্ষায় সমাজের করণীয়

মানুষ সামাজিক জীব। পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রভাব সমাজজীবনে প্রকট। সুতরাং আমাদের সমাজজীবনের প্রতিচ্ছায়া শিক্ষার্থীর মন, মানস ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে। তাই সুশিক্ষার জন্য চাই সহায়ক পরিবেশ; ন্যায়বিচার, সুশাসন, স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক সহনশীলতা।

উন্নত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায়

জাহেলিয়াত ও জাহালত-মূর্খত্ব ও মূর্খতার মাঝে ইসলাম একটি পরিস্কার বিভাজন রেখা টেনে দিয়েছে। ইসলাম স্পষ্ট করে দিয়েছে, জাহেলিয়াত হচ্ছে বিশেষ ওই আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির নাম, যা মিথ্যা-অহংকার, গোত্রীয় অভিজাত্য ও প্রাধান্যের দ্ব›দ্ব, অন্ধ আবেগ ও চেতনা এবং প্রতিশোধ ও চরমপন্থার এক সমন্বিত রূপ। জাহেলিয়াত হচ্ছে শক্তিপুজারী একটি আচরণব্যবস্থা। এতে ধৈর্য ও পরমত সহিষ্ণুতা গণ্য হয় দুর্বলতা হিসেবে। বুদ্ধি ও মেধার ক্ষেত্রে উন্মাদনা এবং সংলাপের জায়গায় প্রতিশোধের আওয়াজ উচ্চকিত করা জাহেলিয়াতের নীতি।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ১৩ বছরের মক্কা জীবনে কাটিয়েছেন সাহাবায়ে কেরামের তরবিয়াত ও জীবন গঠনের পিছনে। এরপর যখন জিহাদের হুকুম হলো তখনও এ নির্দেশনা প্রবল ছিলো, সব শত্রæতা ও বৈরিতার মধ্যেও যেন ন্যায়ের নিশান হাতছাড়া না হয়। জিহাদ হচ্ছে, হক্বের আওয়াজ উর্ধ্বে তুলে ধরা, প্রতিশোধের নাম জিহাদ নয়। তাওহীদের মর্ম একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া, অপর ধর্মানুসারীদের প্রভুদের গালাগাল দেওয়া নয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন মানবতার প্রতি সম্মান। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর শিক্ষায় বর্ণ, বংশ, ভাষা ও সম্পদের ভিত্তিতে কারো মর্যাদা নির্ধারিত হয় না। মর্যাদা ও সম্মান নির্ধারণ হয় কেবল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সুন্নাহ ও আদর্শ বাস্তবায়নের ভিত্তিতে।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর আদর্শ মানুষকে অন্ধকার থেকে সরিয়ে আলোর পথে এনে দেয়। তাঁর মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা সাধিত হয়েছে এবং নবুয়াতের ধারা সমাপ্ত হয়েছে।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সমগ্র জীবনী আলোচনায় ফুটে উঠে, ইসলাম নিরাপত্তার ঘোষক, সততার পতাকাবাহী এবং মানবতার বার্তাবাহক। মানবতার প্রতিটি সদস্যই ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্য ও সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে। ইসলাম বর্ণ ও গোত্রের বিভাজনমালিন্য থেকে মুক্ত। মানবতার সকল শ্রেণি ও স্তরের জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এসেছেন বিশ্বজাহানের রহমাত স্বরূপ।

অমুসলিম নাগরিকদের তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি ইসলাম। ইসলামের দেয়া অধিকার ও মর্যাদায় অমুসলিমরা এতটাই সম্মানিত বোধ করে, পূর্বে এর কোন নজীর তারা পায়নি। সভ্যতা ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিচারে ইসলাম এসেছে একটি পশ্চাৎপদ সমাজে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সেই আরবদের পরিণত করেছেন পৃথিবীর উন্নত জাতিতে। মানব ইতিহাসে তিনিই প্রথম এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা পেশ করেছেন, যা আত্মিক ও বস্তুগত উভয় দিক থেকে মানুষের সংকটমুক্তির দায়িত্ব নিয়েছে।

ইসলাম পৃথিবীর সেই একক ও বৃহত্তম ধর্ম, যা নিঃস্ব ও দরিদ্র জীবনের মাঝে মর্যাদা ও তাৎপর্য দান করেছে। ইসলাম বিভিন্ন গোত্রের মানুষকে পরস্পরে ভাইয়ের মতো থাকার এবং বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার শিক্ষা দিয়েছে। ইসলাম মানব পৃথিবীতে এমন একটি উন্নত সভ্যতা দান করেছে, যার ফলশ্রæতিতে ইসলামি সমাজের রূপ সামনে এসেছে। সে সমাজে মুসলমানদের পাশাপাশি অন্য ধর্মের অনুসারীরাও সৃজনশীলতা ও পরিতৃপ্তির সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করছে।

আজকের এই অশান্ত পৃথিবীতে যে ধর্ম ও কর্মসূচির প্রয়োজন সেটি হলো ইসলাম। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী সকল মানবজাতীর জন্য একটি সমন্বিত সম্পদ। মহান আল্লাহ তাআলার সকল বস্তুগত নিয়ামত যেমন সকল মানুষের জন্য অবারিত, ঠিক তেমনই এই রূহানী নিয়ামতও (প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) সকল মাখলুকের জন্য উন্মুক্ত। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমাত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।”সূরা আম্বিয়া : ১০৭ “তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্যে থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গল কামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।”

আমরা সবাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর উম্মত। তিনি আমাদের কাছে বার্তা দিয়েছেন, বন্ধুত্ব, সহিষ্ণুতা, মানুষের সম্মাননা, নিরাপদ সহাবস্থান, পক্ষপাতমুক্ততা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার। নিরাপত্তা, সৌজন্য ও শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের দায়িত্ব হলো, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর আদর্শের উপর অটুট থাকা এবং অন্যকে এর প্রতি উৎসাহিত করা ও ব্যাপক প্রচার করা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর আদর্শ শিক্ষা আমাদেরকে এমন একটি সমাজ গড়তে অনুপ্রাণিত করে, যে সমাজের প্রতিটি সদস্য হয়ে উঠে সৎ মানুষ। এমন সৎ মানুষ যার গুণাবলি বর্ণিত রয়েছে সূরা আসরে।

ইসলামের দর্শন সম্পর্কে সমাজের প্রতিটি মানুষের অন্তরে থাকতে হবে দৃঢ় বিশ্বাস। প্রতিটি মুহূর্তে অনুভূতি জাগ্রত থাকতে হবে আল্লাহ’র আনুগত্য, সুন্নাতের অনুসরণ, তাকওয়া অবলম্বন এবং আখিরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে। থাকতে হবে দ্বীনি ইলমের চর্চা। পাশাপাশি চলতে হবে বৈষয়িক, আর্থিক ও বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানের চর্চা। দিতে হবে মানুষের শৈল্পিক ও পেশাভিত্তিক মেধা বিকাশের সুযোগ। যেন হালাল জীবিকা অর্জন করতে পারে। মানুষের অন্তরে, চরিত্রে ও জীবনে আনতে হবে শুদ্ধি। সর্বোপরি মানুষের মাঝে সময় ও নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এ সকল ভিত্তির উপরই একটি আদর্শ সমাজের কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। সে সমাজই পৃথিবীর সকল সমাজের উপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলো। বর্তমান যুগেও একটি আদর্শ সমাজের রূপায়ন সম্ভব হবে যখন আমরা মানবতার ত্রানকর্তা, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর শিক্ষা, সীরাত ও আদর্শকে আমাদের কর্মপন্থা হিসেবে গ্রহণ করে নেব। এতেই রয়েছে মানবতার মুক্তি। এতেই রয়েছে কল্যাণ। এতেই রয়েছে সাফল্যের সোপন।

রাষ্ট্রগঠনে অবদান রাখার ক্ষেত্রে

স্বদেশপ্রেম বা স্বদেশ চেতনা ইমানের অঙ্গ। এটি বহুল আলোচিত প্রবাদপ্রতিম মধুর প্রবচন। এতে নিহিত রয়েছে পরিশ্রুত ভাবাবেগ, বৃহত্তর কল্যাণবোধ, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের সংকল্প। নিজ দেশ, নিজ মাতৃভূমি, জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, সংবিধান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্য, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার নামই দেশপ্রেম। এ বোধ, আবেগ ও চেতনা যাদের আছে তারা দেশপ্রেমিকের বিশেষণে বিশেষায়িত। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের মানুষ, সম্পদ ও প্রকৃতির সেবা, লালন ও উত্কর্ষ সাধন হয়ে পড়ে দেশপ্রেমিকের জীবনব্রত।

ইসলামে দেশপ্রেমের পরিধি ব্যাপক। ইসলামে দেশপ্রেমের ভিত্তি হলো আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা (আল হুব্বু ফিল্লাহ), আল্লাহর সৃষ্টিকুলের প্রতি ভালোবাসা ও সেবা (খিদমাতু খালক) এবং মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) অনুসরণ ও মুক্তির প্রত্যাশা। নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের পাশাপাশি অন্য দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সদাচার, সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর ইসলাম সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে।

সৃষ্টির প্রথম দিবস থেকে যেসব নবী ও রাসুল (সা.) মানবজাতির হেদায়েতের জন্য দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত হন, তাঁরা প্রত্যেকে আপন দেশ, মাতৃভূমি ও জনগোষ্ঠীকে ভালোবেসেছেন। কোনো নবী-রাসুল পরিবার, সমাজ ও দেশের মানুষকে পরিত্যাগ করে বনবাদাড়ে, গিরিকন্দরে বা মরুপ্রান্তরে ধ্যানমগ্ন সাধনায় মাসের পর মাস তন্ময় ছিলেন, এমন ইতিহাস নেই। দ্বীন প্রচার, দ্বীন প্রতিষ্ঠা, স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণ সাধন ও অশুভ শক্তির দমন ছিল তাঁদের নবুওয়তির মিশন। স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশচেতনা হচ্ছে সুন্নাতে আম্বিয়া (আ.)।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন। নবুওয়ত-পরবর্তী প্রথম পর্যায়ে ১৩ বছর তিনি অত্যন্ত বাধা-বিপত্তির মধ্যে মক্কায় ধর্মপ্রচারে ব্রতী ছিলেন। নিবর্তন ও সংঘাতের তাণ্ডব যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন ৬২২ খ্রিস্টাব্দে দাওয়াতের আরেক দিগন্ত উন্মোচনের উদ্দেশ্যে হিজরত করে মদিনা রওনা হন। মদিনা যাত্রাপথে তিনি জন্মভূমি মক্কার পানে তাকিয়ে অশ্রুপাত করেন বারবার। তিনি মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমার শহর কতই না সুন্দর, আমি তোমায় ভালোবাসি। আমার জনগণ যদি আমাকে বের করে না দিত, কখনো আমি তোমায় ছেড়ে অন্য কোথাও যেতাম না।জামে তিরমিজি : ৩৯৫২

৬২২ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মদিনা হয়ে উঠে মহানবী (সা.) কর্তৃক দ্বীনপ্রচার, দ্বীনের আরকান-আহকাম বাস্তবায়ন, রাষ্ট্র পরিচালনা, শান্তিচুক্তি সম্পাদন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপন, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ‘মদিনা সনদ’ ঘোষণার কেন্দ্রস্থল। এ মদিনায় রচিত হয় তাঁর সমাধিস্থল ‘রাওজা আকদাস’। তিনি মদিনার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন। মক্কার পাশাপাশি মদিনার প্রতি ছিল তাঁর আজীবনের ভালোবাসা। তিনি বলেন, ‘আমি উহুদ পর্বতমালাকে ভালোবাসি আর উহুদও আমায় ভালোবাসে।’সহিহ বুখারি : ২৮৮৯ হিজরত করে মদিনা গেলেও মক্কার সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন মহানবী (সা.)। ফলে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মক্কা বিজয় সম্ভব হয়। বিজয়ের দিন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নেওয়া এবং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার ফলে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।

দেশের রূপ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, জলবায়ু সুরক্ষায় একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অহেতুক গাছপালা কর্তন, জনগণের চলার পথে প্রবহমান পানিতে মলমূত্র ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বনায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘কিয়ামত হয়ে যাবে এটা যদি আগেভাগে অনুমান করতে পারো, তাহলে হাতে রক্ষিত গাছের চারা রোপণ করে দাও।’

জাতীয় অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দেওয়া নফল ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াব। ‘আত-তারগিব ওয়াত তারহিব’ নামক গ্রন্থে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিস উল্লিখিত হয়েছে। এতে তিনি বলেন, ‘লাইলাতুল কদরের চেয়ে আরো একটি পুণ্যময় রাতের খবর তোমাদের দেব কি?’ সাহাবারা জবাব দেন, ‘বলুন ইয়া রাসুলাল্লাহ!’ মহানবী (সা.) বললেল, ‘কোনো সৈনিক রাতে এমন কোনো কঠিন ভীতিপ্রদ চৌকিতে দাঁড়িয়ে সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে; যেকোনো মুহূর্তে শত্রুর উদ্ধত অস্ত্রের আঘাতে তার বক্ষ বিদীর্ণ হতে পারে এবং জীবনে আর স্ত্রী-সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ নাও আসতে পারে—সে রজনী লাইলাতুল কদরের চেয়েও বেশি বরকতপূর্ণ।’

সবল রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্র দখল করে সম্পদ লুণ্ঠন ও আর্থ-রাজনৈতিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা একটি পুরনো রেওয়াজ। বৈদেশিক আগ্রাসী শক্তির উদ্ধত থাবা গুঁড়িয়ে দিতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হয়। এ দায়িত্ব ও ঔচিত্যবোধ থেকে মহানবী (সা.) মদিনা প্রজাতন্ত্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় প্রায় ২৭টি যুদ্ধে সশরীরে অংশ নেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এসব যুদ্ধ ‘গাজওয়া’ নামে খ্যাত।

ক্ষুদ্র স্বার্থ ও ব্যক্তিগত কল্যাণের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় স্বার্থ ও সামষ্টিক কল্যাণ যখন নাগরিকের মনে ও কর্মে সক্রিয় হয়ে উঠে, তখন জ্বলে ওঠে দেশাত্মবোধের অনির্বাণ শিখা। ধর্ম, দেশ, জাতি যখন বহিঃশত্রুর আগ্রাসনের শিকার হয়, লুণ্ঠনের মহড়া চলে এবং জুলুমের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তখন গোটা জাতির সুপ্তিমগ্ন দেশপ্রেম জেগে ওঠে, তারা প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রাণ উত্সর্গ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ধর্মপরায়ণতা জাতিকে ঐক্যের ডোরে আবদ্ধ করে। অন্যদিকে ধর্মান্ধতা বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিভাজিত করে ফেলে। ধর্মপরায়ণ দেশপ্রেমিক আপন মাতৃভূমিকে ভালোবাসে, সমর্থন করে ও দেশ রক্ষায় জীবন বাজি রাখে।

অন্যদিকে ধর্মান্ধ দেশপ্রেমিক নিজ ধর্মগোষ্ঠী, বর্ণ ও দলীয় রাজনীতির প্রতি থাকে পক্ষপাতপূর্ণ ও একপার্শ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। উদারতা ও ভালোবাসা থেকে নিষ্কলুষ দেশপ্রেম জন্ম নেয় আর ঘৃণা, ভিন্নমত ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি হীনমানসিকতা পোষণ থেকে তৈরি হয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা। নিজের লোক, নিজের দল ও নিজেদের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত কোনো ভুল সিদ্ধান্ত বা আদেশ অন্ধভাবে সমর্থন উগ্র জাতীয়তার পরিচয়। দেশপ্রেমের নামে বর্ণবাদী ধারণা বিশ্বে অনেক বিপর্যয় সৃষ্টি করে। উগ্র জাতীয়তা (আসাবিয়া) ইসলাম অনুমোদন করে না, এটা পাপ হিসেবে গণ্য। সুনানে আবু দাউদ : ৫০৯৭ হিটলার ও মুসোলিনি এমন মানসিকতার অধিকারী ছিলেন। দেশপ্রেমের নামে তাঁরা যথাক্রমে জার্মানি ও ইতালিকে অন্ধভাবে ভালোবাসতেন, অন্যান্য দেশ ও জাতিকে ঘৃণা করতেন এবং গোটা বিশ্বকে পদানত করতে চাইতেন।

দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা, রাষ্ট্রের সংবিধান, প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে চলা, রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উত্স ‘কর’ আদায়ে সচেষ্ট থাকা, নাগরিকের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা, নিজস্ব কৃষ্টি ও মূল্যবোধ চর্চা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ ও দুর্নীতির প্রতিবাদ। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি দেশপ্রেমিক নাগরিকের অধিকারও ব্যাপক। নিজের নিরাপত্তা লাভ, ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা, মতামত প্রকাশ, ভোটাধিকার প্রয়োগ, ধর্মচর্চা, আইনের ক্ষেত্রে সমতা, বিচারপ্রাপ্তি ইত্যাদি অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭-৪৪ অনুচ্ছেদে মোট ১৮টি মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে প্রতিকার পাওয়ার বিধান রয়েছে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ইসলাম চর্চার বর্তমান অবস্থা

সামাজিক কার্যক্রমে ইসলাম চর্চা

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দেশের সবচেয়ে অবহেলিত অংশ। তারা তাদের সামাজিক নিচু অবস্থার দরুণ মূলধারার সমাজব্যবস্থার সাথে যথাযথ সম্পৃক্ততা বজায় রাখতে পারে না। তাদের সামাজিক সচেতনতার অভাবে একদিকে যেমন রাষ্ট্র ও সমাজে তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা অসচেন, অন্যদিকে ইসলামী জীবনব্যস্থার আলো থেকেও তারা বঞ্চিত।

পূর্বে আলোচিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান সম্পর্কিত আলোচনায় তাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার দিক ফুটে উঠেছে। যার ফলে এটা অনেকটাই অনুমেয় যে, ইসলামী জীবনবিধানের আলোকে তারা তাদের সমাজকে পরিচালিত করে না। যদিও বেদে ও জেলেদের অনেক অনুষ্ঠান ও সামাজিক রীতিতে মিলাদ মাহফিল ও শিরনীর আয়োজন করা হয়, তা একান্তই তাদের নিকট উৎসব মাত্র। এতে ধর্মীয় চেতনা বলতে কিছু নেই। এ ধরনের বেশ কিছু সামাজিক কার্যক্রম সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা

বাংলাদেশের মুসলমানদের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে  ঈদুল ফিত্‌র ও  ঈদুল আযহা। রমজান শেষে ঈদুল ফিত্‌র পালিত হয়। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব, আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। অন্যান্য সামাজিক উৎসবের মতো ঈদও বারবার ফিরে আসে। একই কথা প্রযোজ্য ঈদুল আযহা ও হজ্জ সম্পর্কেও। আদি যুগে এ দুটি উৎসব পালনে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাসের প্রভাব ছিল, পরে কিছু ধর্মীয় রীতি-নীতি যুক্ত হয়। বর্তমানে উৎসব দুটি যতটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে, আগে সেভাবে হতো না; কারণ তখন ঔপনিবেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল, সে সঙ্গে ছিল জনগণের দারিদ্র্য এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা।

উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকায়ত মেলা। সে ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে এবং বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমপক্ষে বারোটি মেলার আয়োজন করা হয়। বিগত একশ বছরে বাঙালি মুসলমানরা যেভাবে ঈদ পালন করতেন তার বিবরণে দেখা যায়, ঈদ উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল বিশেষ ধরনের খাওয়া-দাওয়া। ঈদের খাওয়ার তালিকায় প্রধান হয়ে উঠত ঘরে তৈরী মিষ্টান্ন। পরবর্তীকালে ঈদের সঙ্গে কিছু স্থানীয় উপাদান যুক্ত হয়েছে, যার অনেকগুলি এসেছে বিভিন্ন লোকাচার থেকে, যেমন ঈদের চাঁদ দেখে সালাম দেওয়া, কদমবুসি করা, মেলা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়।

শবে বরাত

শবে বরাআত  মুসলমানদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হিজরি সনের শাবান মাসের পঞ্চদশ রাতে এ অনুষ্ঠান পালিত হয়। ‘শবে বরাআত’ একটি  ফারসি যৌগিক শব্দ; ‘শব’ অর্থ রাত্রি এবং ‘বরাআত’ অর্থ মুক্তি, যার সম্মিলিত অর্থ দাঁড়ায় মুক্তি পাওয়ার রাত্রি। একে আরবিতে ‘লায়লাতুল বরাআত’ বলা হয়, যার অর্থ মুক্তির রাত্রি। উপমহাদেশে শবে বরাআত প্রধানত সৌভাগ্য রজনী হিসেবে পালিত হয়।

শবে বরাআত উদ্যাপনের বিশেষ তাৎপর্য আছে। মুসলমানদের ধারণা, এ রাতে পরের বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয়; সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে মানুষের গুনা মাফ হওয়ার আশা করা যায়।

শবে বরাআতের সময় আগরবাতি, মোমবাতি বা বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে সর্বত্র আলোকসজ্জা করা হয়; এ ধরনের কাজ শবে বরাআতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শবে বরাআতের দিন হালুয়া-রুটি ইত্যাদি খাবার তৈরি করে প্রতিবেশী ও গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। মুসল্লিগণ মসজিদে গিয়ে সালাত ও জিকরে রত হন। দিনে সিয়াম ও রাতে নফল  নামায আদায় করা হয়। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, নবী করিম (সা.) শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে মদিনার জান্নাতুল বকী গোরস্থানে কবর জিয়ারত করেছিলেন এবং উম্মুল মুমিনীল আইশা (রা)-কে এ রাতে ইবাদত করতে বলেছিলেন। শাবানের পনের তারিখে নফল রোজা রাখার বিধান আছে।

আল-কুরআনে শবে বরাআতের উল্লেখ নেই। তবে সূরায়ে দুখানে লায়লা মুবারাকার উল্লেখ আছে। কোনো কোনো তাফসিরকার লায়লা মুবারাকা দ্বারা শবে বরাআতকে বোঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

শবে ক্বদর

শবে কদর  ইসলাম ধর্মমতে বছরের সর্বাধিক বরকতময় রাত।  কুরআন ও হাদিসে এর নাম ‘লায়লাতুল কাদ্র’; বাংলাদেশে শবে কদর হিসেবেই পরিচিত। শব  ফারসি শব্দ, অর্থ রাত, কদর  আরবি, অর্থ মর্যাদা, ক্ষমতা। শবে কদর অর্থ ‘মর্যাদার রাত’। এই পবিত্র রাতে হেরা গুহায় নবী করীম (স.)-এর নিকট আল-কুরআনের প্রথম সূরার (‘আলাক) পাঁচটি আয়াত নাযিল হয়।

শবে কদর সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছি মহিমান্বিত রজনীতে; আর মহিমান্বিত রজনী সম্বন্ধে তুমি কী জান? মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; সেই রাত্রিতে ফিরিশতাগণ ও রূহ্ অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাহাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে; শান্তি, শান্তি, সেই রজনীর উষার আবির্ভাব পর্যন্ত’ (৯৭ঃ ১-৫)। এই মহিমান্বিত রাতটি মুসলমানদের জন্য আল্লাহর এক বিরাট রহমত, কারণ এই একটি মাত্র রাতে ইবাদত করে তারা হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা অধিক সওয়াব পেতে পারে।

শবে কদরের তারিখ সম্পর্কে মতভেদ আছে। কুরআনে  রমজান মাসের উল্লেখ আছে, তবে কোনো নির্দিষ্ট তারিখের কথা নেই। হাদিসে এর তারিখ সম্পর্কে মহানবীর (স.) বিভিন্ন উক্তি আছে: ‘রমজানের শেষ দশকের মধ্যে একটি বে-জোড় রাত, শেষ সাত দিনের মধ্যে একটি বে-জোড় রাত, ২১তম, ২৩তম ও ২৫তম রাতের বা ২৫তম, ২৭তম ও ২৯তম রাতের মধ্যে একটি।’ মহানবী (স.) মুমিনগণকে এই রাতে অত্যধিক ইবাদত করার আদেশ দিয়েছেন। অধিকাংশ আলিম মনে করেন যে, রমজানের ২৭তম রাতই শবে কদর। বাংলাদেশেও এই মত প্রচলিত। শবে কদরের রাত জেগে কেউ ইবাদত করলে তার অতীতের সমুদয় পাপ মার্জনা করা হয়।

বাংলাদেশে গভীর ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে শবে কদর উদ্যাপিত হয়। ইশার নামাযের সময় মুসল্লিগণ মসজিদে একত্রিত হন এবং অনেকে শেষরাত পর্যন্ত নফল ইবাদত করেন। শবে কদরের পরদিন (২৭তম রমজান) বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকে। রেডিও-টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে ও পত্র-পত্রিকায় বিশেষ বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সারাদেশে একটি ভাবগাম্ভীর্যময় ধর্মীয় অবস্থা বিরাজ করে।  

ওয়াজ মাহফিল

গ্রামে গ্রামে ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি। বাংলাদেশে ইসলামের প্রসার ঘটেছে বিভিন্ন পীর-আউলিয়া, দরবেশ-মাওলানা আর হুজুরদের বয়ানের মাধ্যমে। যেসব মুসলিম সেনাপতি বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চল জয় করেন, তারা ধর্মপ্রচারের জন্য আসেননি। তারা এসেছিলেন রাজ্য জয়ের জন্য। তারা কেবল স্থানে স্থানে সিপাহী দিয়ে কিছু রাজ্যই জয় করেছেন, কিন্তু ইসলামের বিচ্ছুরিত আলোকবিভা দিয়ে বঙ্গের মানুষের মন জয় করেছেন দরবেশ-ফকির, পীর-আউলিয়া, মাওলানা আর হুজুররা। এই মাওলানারাই নিরাপদ আর সুরক্ষিত রেখেছে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। বাংলার প্রতিটি জনপদে নিভৃতে জ্বলতে থাকা মাদরাসাশিক্ষা, মসজিদের মিম্বার থেকে ধ্বনিত হওয়া ইমাম সাহেবের বয়ান, ওয়াজ-মাহফিলের মাইকে বেজে ওঠা মাওলানা আর মুফতিদের দরদি বয়ান আলোর পথ দেখিয়েছে এ অঞ্চলের মানুষদের।এ মাহফিল সংস্কৃতি তাদেরই হাজার বছরের অবদান।

শীত মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে শুরু হয় ওয়াজ-মাহফিলের উৎসব। এই উৎসব আগেও ছিল, তবে এখনকার মতো এত ব্যাপক পরিসরে ছিল না। বড় বড় মাদরাসাকেন্দ্রিক কিছু মাহফিল হতো। এখন এসব মাহফিলের আয়োজন করা হয় বিভিন্ন মাদরাসা, মসজিদ পরিচালনা কমিটি, গ্রামে-গঞ্জে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে। এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগেও আয়োজিত হয় কিছু মাহফিল। আর মাহফিলের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দেয় এলাকার যুবকরা। মাহফিল প্রচারণা, পোস্টারিং, ডেকোরেশন থেকে শুরু করে মাহফিল চলাকালীন স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পর্যন্ত।

আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগেও গ্রামে-গঞ্জে ব্যাপকহারে আয়োজন করা হতো যাত্রা ও অশ্লীল নৃত্যের। তখন মাহফিল হতো হাতেগোণা। কিন্তু দিনদিন মাহফিলের সংখ্যা যত বেড়েছে, কমেছে যাত্রপালার সংখ্যা। যেখানে আলো আসে, অন্ধকার সেখানে খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। এটা প্রকৃতির নীতি। হয়েছেও তাই। এখন যাত্রপালা খুঁজেই পাওয়া যায় না। কিন্তু কান পাতলে দৈনিক কোনো না কোনো গ্রামে মাহফিলের সুর শোনা যাবেই। মাহফিল সংস্কৃতির কারণেই আজ বাংলাদেশে যাত্রা ও অশ্লীল নৃত্যের সংস্কৃতি সমূলে উৎপাটিত প্রায়। এ অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

মিলাদ মাহফিল

মীলাদ  আরবী মাওলিদ শব্দ থেকে মীলাদ। মাওলিদ মানে কোনো ব্যক্তির, বিশেষ করে নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মকাল, জন্মস্থান, জন্মদিন এবং জন্মোৎসব। জন্মকাল অর্থে মীলাদ শব্দের ব্যবহার হয়। এই উপমহাদেশে মাওলিদ শব্দের পরিবর্তে ‘‘মৌলুদ’’ বা ‘‘মৌলুদ শরীফ’’ আখ্যা প্রচলিত আছে। কিন্তু অধুনা মীলাদ শব্দটি বাংলাদেশে ব্যবহূত হয়। সাধারণত ১২ রবী’উল-আওয়াল তারিখে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব উদযাপিত হয়। তবে, যেকোনো ব্যক্তির জন্মদিন,  বিবাহ, নতুন ব্যবসায়ের সূত্রপাত, গৃহনির্মাণ সমাপ্তি ইত্যাদি উপলক্ষেও বছরে যেকোনো সময় মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হতে পারে।

মীলাদ অনুষ্ঠানে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বর্ণাঢ্য, মহান জীবনের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয় এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থা আলোচিত হয়। পবিত্র আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতও তিলাওয়াত করা হয়। নবীজীর (সাঃ) প্রশংসামূলক না‘ত পরিবেশিত হয়। এছাড়াও ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যু সম্পর্কে ইসলামী মতাদর্শও আলোচিত হয়। না‘ত সাধারণত সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়।

ফাতেহা পাঠ

মৃত ব্যক্তির জন্য ঈসালে ছওয়াব বা পুণ্য পৌঁছানোর উদ্দেশে কুরআন তেলাওয়াত ও সদকা খয়রাত বা বিশেষ ভোজের আয়োজনপূর্বক যে দোয়া অনুষ্ঠান পরিচালিত হয় তা ফাতিহা নামে পরিচিত। কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যে সূরা ফাতিহা, সূরা বাকারার প্রথম কয়েক আয়াত, আয়াতুল কুরসী, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, সূরা ইয়াসীন, সূরা মূলক, সূরা তাকাস্বুর ও সূরা ইখলাস এগারো অথবা সাতবার, ন্যূনপক্ষে তিনবার পাঠ করা হয়। এ অনুষ্ঠানে সূরা ফাতিহা অবশ্যপাঠ্য বলেই এর নাম হয়েছে ফাতিহা। কখনো কখনো তা ফাতিহাখানী নামেও অভিহিত হয়। ইরান, মধ্য এশিয়া ও বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর সাধারণত চতুর্থ দিনে ফাতিহা অনুষ্ঠানকে  কুলখানি, ৪০তম দিবসকে চেহলাম বা চল্লিশা বলা হয়।

মাযার

মাযার শব্দটি আরবি দরগাহ শব্দের প্রতিশব্দ। এর ধাতুগত অর্থ ‘যিয়ারতের স্থান’। মাযার বলতে সাধারণত আওলিয়া-দরবেশগণের সমাধিস্থলকে বোঝায়।

মাযারকে রওযা বা কবরও বলা হয়। এর নিকটবর্তী স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, মকতব ইত্যাদি গড়ে ওঠে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) মদীনার কবরস্থান জান্নাত-আল বাকীতে এবং উহুদযুদ্ধে শাহাদতপ্রাপ্ত সাহাবীদের কবরস্থানে গমন করতেন এবং তাঁদের জন্য দোয়া করতেন। কবরকে মসজিদে পরিণত করা অর্থাৎ সিজদাহ করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

মাযারের প্রতি মুসলমানদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় সুফী তরীকাগুলির প্রভাবের ফলে। সুফীতত্ত্বের অনুসারী মুসলমানরা সুফী দরবেশদের কবরস্থান যিয়ারত করতে পছন্দ করেন। অনেক মাযারে সমাধিস্থ ব্যক্তির উরস অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। একে ঈসালে ছওয়াবের মাহফিল বলে। ঐতিহাসিক মাযারগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওয়াক্ফ সম্পত্তি থাকে এবং খাদিমও থাকেন; অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা উত্তরাধিকারসূত্রে এ পদে অধিষ্ঠিত হন।

ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে আগত ইসলাম প্রচারক আওলিয়া-দরবেশদের মাযারগুলি এখনও বিদ্যমান, যথা: আজমীরে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতির (র.) মাযার, দিল্লিতে নিযামউদ্দীন আওলিয়ার (র.) মাযার, লাহোরে ফরিদউদ্দীন গঞ্জ-এ-শাক্কারের (র.) মাযার, সিলেটে হযরত শাহ জালালের (র.) মাযার, রাজশাহীর শাহ মখদুম (র.) মাযার, ঢাকায় শাহ আলী বাগদাদী (র.)-এর মাযার, খুলনায় খানজাহান আলী (র.)-এর মাযার ইত্যাদি। চট্টগ্রাম মাযারের শহর হিসেবে খ্যাত, কারণ সেখানে বারো-আওলিয়ার মাযার আছে।

বাউল গান

বাউল লোকসম্প্রদায়ের একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী, যারা গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা গেলেও সাধারণত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর এবং পাবনা অঞ্চলেই এদের বেশি দেখা যায়। বাউলরা দেহভিত্তিক গুপ্ত সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সহজিয়া ও সুফি সাধনার সম্মিলন ঘটেছে; তবে সুফি ভাবনার প্রভাবই বেশি। বাউলরা মসজিদ বা মন্দিরে যায় না। কোনো ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই। মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য বা জাতিভেদে তারা বিশ্বাসী নয়। তারা মানবতাবাদী। তাদের বিশ্বাস জন্মগতভাবে কেউ বাউল নয়, গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়েই বাউল হতে হয়। বাউল সাধনা মূলত নারী-পুরুষের যুগলসাধনা। তবে জ্ঞানমার্গীয় একক যোগসাধনাও আছে।

বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘বাউল’ শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পনের শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীরের  ইউসুফ-জুলেখা, মালাধর বসুর  শ্রীকৃষ্ণবিজয়, ষোলো শতকের বাহরাম খানের   লায়লী-মজনু এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের  চৈতন্যচরিতামৃত  গ্রন্থে ‘বাউল’ শব্দের ব্যবহার আছে। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, অন্ততঃপক্ষে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। সাম্প্রতিককালের এক গবেষণায় জানা যায় যে, পারস্যে অষ্টম-নবম শতকে সুফিসাধনা প্রবর্তনকালে ‘বা’আল’ নামে সুফি সাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। তারা ছিল সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্ত সাধনপন্থী। মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে তারা গান গেয়ে বেড়াত। অন্যান্য সুফিসাধকদের মতো তারাও এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই বাংলায় বাউল সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে।

জারি গান

জারি গান  পয়ার ছন্দে রচিত আখ্যানমূলক গাথা বা পাঁচালি। ‘জারি’ ফারসি শব্দ, অর্থ ক্রন্দন, বিলাপ বা প্রচার করা। এর উদ্ভব কারবালার হূদয়বিদারক বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার জন্য  মুহররম মাসের প্রথম দশদিন হযরত ইমাম হোসেন ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের স্মরণে মর্সিয়া এবং জারি গান গীত হয়ে থাকে। পরে অবশ্য এ বিষয়টি ছাড়াও জারি গানের আঙ্গিক ও সুরে অন্য অনেক বিষয় স্থান পেয়েছে। ফলে অঞ্চল বিশেষে এ গানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও কোনো কোনো অঞ্চলে এর বিষয়বৈচিত্র্য রয়েছে। মক্কার জন্মকথা, জহরনামা, সাদ্দাদের জারি, শাহজালালের জারি, সোহরাব-রোস্তমের জারি ইত্যাদির পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ব্যঙ্গরসাত্মক বিষয়, পরিবার-পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ক জারি গান সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

কাওয়ালী গান

কাওয়ালি  এক প্রকার আধ্যাত্মিক প্রেমবিষয়ক ভক্তিমূলক গান। ‘কওল’ থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি। আমীর খসরু এই ধারা সঙ্গীতের প্রবর্তক। এ গান মূলত সুফি সাধকরা গেয়ে থাকেন। ফারসি ও উর্দু ভাষায় রচিত কাওয়ালি গান মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। এ গানের স্থায়ী ও অন্তরার মধ্যে  তাল বন্ধ রেখে প্রতিবার বিভিন্ন প্রকার স্বরবিন্যাস বা রাগের সমাবেশ করা হয়। সাধারণত দলগতভাবে এ গান গাওয়া হয়। এতে একজন মূল গায়ক থাকেন, অন্যরা ধুয়া ধরে। তালযন্ত্র হিসেবে এতে ঢোলক ব্যবহূত হয় এবং সমবেতভাবে হাততালি দিয়ে তাল রক্ষা করা হয়। এটি কাওয়ালি গানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে সকল  রাগ আধ্যাত্মিক প্রেমপ্রকাশক সে সকল রাগে কাওয়ালি গান গাওয়া হয়। এতে দাদরা, ধূমালি, রূপক, পশ্তু ইত্যাদি তাল ব্যবহূত হয়। কাওয়ালি গানের শিল্পীরা ‘কাওয়াল’ নামে পরিচিত। পুরান ঢাকার আদিবাসীদের মধ্যে এ গানের প্রচলন আছে। তারা বিভিন্ন জলসা, বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে এ গানের আয়োজন করে থাকে।

পুঁথি পাঠ

বাংলা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ পুঁথি পাঠ। একসময় রাজ্যসভাগুলোতে মহারাজাদের সামনে বসত পুঁথি পাঠের আসর। পুঁথি পাঠকারীর সুরের মূর্ছনা, উপস্থাপনা আর গল্পের বৈচিত্র্যের কারণে মাহারাজাসহ উপস্থিত দর্শকরা কখনো হাসত, আবার কখনো বা কাঁদত। বয়োবৃদ্ধ অনেকের স্মৃতিতে আজও পুঁথি পাঠ ও পুঁথি পাঠের আসরের সেই রোমাঞ্চ জ্বলজ্বল করছে।

শিরনী বিতরণ

শিরনী  পীরের উদ্দেশে নিবেদিত  মিষ্টান্ন বা চাল-আটা-দুধ-কলা-চিনির তৈরি খাদ্যবিশেষ। ‘শিরনী’ শব্দটি ফারসি; বাংলার মুসলিম সমাজে এটি ‘শিন্নি’ নামেও প্রচলিত। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বরকত ও পুণ্য লাভের আশায় স্রষ্টার প্রতি নিবেদন করে শিরনী বিতরণ করা মুসলমান সমাজের একটি রেওয়াজ। মসজিদ,  মাদ্রাসা, খানকাহ,  দরগাহ,  মাযার প্রভৃতি স্থানে মানুষ শির্নী বিতরণ করে এই উদ্দেশ্যে যে, এতে স্রষ্টা সন্তুষ্ট হয়ে তাদের বিপদ-আপদ ও রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করবেন। কাজের সফলতা ও উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যেও শির্নী মানত করা হয়।

শিরনী প্রথার প্রচলন ইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল না; পীরবাদের সঙ্গে এর প্রচলন ঘটে। সাধারণ লোকের বিশ্বাস, পীরেরা কারামতের অধিকারী। লোকজন পীরের খানকাহ্কে পৃথিবীতে শান্তির আশ্রয় হিসেবে মনে করে। এরূপ অসাধারণ ব্যক্তির প্রতি তাঁরা গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং তাঁদের নামে শিরনী দেয়। ক্রমে এ ব্যবস্থা বিস্তার লাভ করে এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, কোনো কোনো অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যেও পীরভক্তির প্রচলন ঘটে।

চল্লিশা বা কূলখানী

কুলখানি  ইসলামি অনুষ্ঠানবিশেষ। তবে এটি বিধিবদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। সাধারণত মৃতব্যক্তির দাফনের চতুর্থ দিনে কুলখানি অনুষ্ঠিত হয়। উপমহাদেশে এর চর্চা বহুকাল থেকেই হয়ে আসছে। মৃত্যুর পর সাধারণত মৃতব্যক্তির গৃহে চল্লিশ দিন যাবৎ  কুরআন তেলাওয়াত করার রীতি রয়েছে।

কুলখানিতে মৃতের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব সমবেত হয়ে দোয়া-দরুদ পাঠ করেন। সাধারণত স্থানীয় মসজিদের  ইমাম অথবা মৃতের কোনো প্রিয় ব্যক্তির পরিচালনায়  মীলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। ইমাম মৃত্যুর ওপর আলোকপাত করে বক্তব্য প্রদান করেন। কোনো কোনো ইমাম আজরাইলের (আ.) আগমন ও কবরের আযাব (শাস্তি) সম্বন্ধে বিভিন্ন বর্ণনা দেন। দরুদ পাঠ শেষে জীবিত ও মৃতদের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করা হয়। মৃতব্যক্তির সৎকর্ম সম্বন্ধেও বক্তব্য রাখা হয়। অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে তবাররুক বিতরণ করা হয়।

সচরাচর মৃতব্যক্তির বাড়িতেই কুলখানি অনুষ্ঠিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় মসজিদ, যেখানে মৃতব্যক্তি জুমু‘আর  নামায আদায় করতেন বা তাঁর পরিবার যার সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে জড়িত, সেখানে কুলখানি অনুষ্ঠিত হয়।

খাতনা বা মুসলমানি

খতনা বা মুসলমানি পারিবারিক উৎসব হিসেবে বিয়ের তুলনায় এতটা ব্যাপক না হলেও কোথাও কোথাও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালিত হয়। বিশেষত বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্তর্গত টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলে ছেলের খতনা উপলক্ষে তাকে গোসল করিয়ে নতুন জামা-কাপড় পরানো এবং পরে পালকিতে বা ঘোড়ায় চড়িয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করানোর প্রচলন এখনো আছে।

তাবিজ কবচ

দেহে রোগ-ব্যাধির অন্যতম কারণ নানারূপ জীবাণু- এই বৈজ্ঞানিক সত্য জানা থাকলেও রোগের পিছনে এক একটি দৈবশক্তির প্রভাবকে অনেকে বিশ্বাস করে। এ ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। কলেরার দেবী ওলাদেবী বা ওলাবিবি, বসন্তের দেবী শীতলা, খোস-পাঁচড়ার অপদেবতা ঘেঁটু। এদের পূজা-মানত করলে ওইসব রোগ-শোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই দেবতাকে সন্তুষ্ট করে নিরাপদ জীবন লাভের জন্য তাদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। ওলাদেবীকে ওলাবিবি, বনদুর্গাকে বনবিবি, দক্ষিণ রায়কে গাজীপীর রূপান্তর মুসলমানদেরই কল্পনাপ্রসূত। এরূপ বিশ্বাস-সংস্কারের ভিত্তিমূল এতই দৃঢ় যে, আধুনিক চিকিৎসা-পদ্ধতির প্রচলন হলেও গ্রামজীবন থেকে তা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি, কোনো কোনো অঞ্চলে পুরাপুরি বিদ্যমান আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে নানান ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ ও গাছ-গাছড়ার চিকিৎসা। দক্ষিণবঙ্গের বাওয়ালি, কাঠুরিয়া, মউলে, জেলে প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষ সুন্দরবনে প্রবেশ করার আগে কোথাও গাজীপীরের, কোথাও বনবিবির মানত-শিরনি পালন করে থাকে।

ঝাড়ফুঁক ও পানিপড়া

গ্রামীণ সমাজে তো বটেই, শহুরে সমাজেরও বিরাট একটি অংশে ব্যাপক বিশ্বাস রয়েছে যে, রোগ নিরাময়ে একজনকে অতিপ্রাকৃত শক্তির সহায়তা নিতে হয়। এই অতিপ্রাকৃত শক্তি বিরাজ করে পীর, ফকির প্রমুখের মাঝে। সাধারণত প্রথাগত নিরাময় পদ্ধতিতে পানিপড়া, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, তেলপড়া ইত্যাদির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলাম

শিক্ষাব্যবস্থায় অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণও যথেষ্ট কম। তবে সম্প্রতি প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বেদে, জেলে, কামার, কুমার ও বিভিন্ন আদিবসী জনগোষ্ঠীর সন্তানেরা পড়াশোনা করতে গিয়ে সরকারি বৃত্তিসহ বেশ কিছু সহায়তা পাচ্ছে।[12] কিন্তু ইসলামী শিক্ষার প্রসারে তাদের জন্য তেমন কোন উদ্যোগ নেই। এদিকে গত কয়েক বছরে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য একাধিক মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক।[13] কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যান্য সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে সামগ্রিক কোন ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম নেই।

উপসংহার

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে ইসলামের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত বলেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। একই সাথে তাদের ইসলাম চর্চার মধ্যেও প্রকৃত ইসলামী আদর্শের ছোঁয়া নেই। বরং, সেগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাদের কিছু প্রথাগত উৎসব মাত্র। তাই তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নে ইসলাম চর্চার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে তারা যে সকল সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।


[1] Peter Saunders, Social Class and Stratification (Routledge, 1990)

[2] নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস : আদি পর্ব, (১ম সংস্করণ), কলকাতা, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ

[3] Rita Jalali (২০০০), “CASTE AND INHERITED STATUS”, Edgar F. Borgatta; Rhonda J. V. Montgomery, Encyclopedia of Sociology, 1 (2nd সংস্করণ), Macmillan, পৃষ্ঠা 249–255

[4] মনিরুল ইসলাম খান, সামাজিক স্তরবিন্যাস, নিবন্ধ, বাংলাপিডিয়া অনলাইন সংস্করণ

[5] Rahim, Enayetur. “Social Classes and Stratification”. In Heitzman and Worden.

[6] মনিরুল ইসলাম খান, প্রাগুক্ত

[7] Bangladesh Country Study Guide (ইংরেজি ভাষায়) (Volume 1 Strategic Information and Developments সংস্করণ)। International Business Publication। পৃষ্ঠা ৮২–১০৯।

[8] জামিল চৌধুরী (সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী আধুনিক বাংলা অভিধান (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ২০১৬), পৃ. ৮৮২

[9] https://www.merriam-webster.com

[10] বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ওয়েবসাইট, http://www.bbs.gov.bd/

[11] মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজ (সহকারী পরিচালক, সমাজসেবা অধিদফতর, বিভাগীয় কার্যালয়, চট্টগ্রাম), প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা, পত্রিকা কলাম, কালের কণ্ঠ, ২২ অক্টোবর, ২০২০

[12] বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প, সমাজসেবা অধিদপ্তর, https://prantikdss.gov.bd/

[13] দৈনিক ইনকিলাব, ৩ নভেম্বর, ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More To Explore

Scroll to Top