সাপ্তাহিক জুমু’আর বয়ান। বিষয়: ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকা: ইসলামী রাষ্ট্র বলতে এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝানো হয় যা ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এই ধরনের রাষ্ট্রে শাসনব্যবস্থা, আইন, নীতি, এবং নৈতিকতা ইসলামী শারীআহ বা ইসলামি আইন অনুযায়ী গঠিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নির্দেশিত বিধান মেনে চলা এবং সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।

ইসলামী রাষ্ট্রের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য হলো:

১. শাসননীতি: ইসলামী রাষ্ট্রের শাসননীতি কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে গঠিত হয়। শাসক বা নেতা কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে সমাজ পরিচালনা করেন।

২. আইন ব্যবস্থা: ইসলামী রাষ্ট্রে আইন ইসলামী শরীআহ অনুযায়ী প্রণীত হয়, যেখানে ব্যক্তি ও সমাজের সকল কার্যক্রম ইসলামের বিধান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। তথা যাবতীয় আইন হবে মানুষের কল্যাণে এবং কোন আইন শরীয়ার বিরুদ্ধে যাবেনা।

৩. সামাজিক ন্যায়বিচার: ইসলামী রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ধনী ও গরিবের মধ্যে ন্যায্য বণ্টন, দুর্নীতি দমন, এবং সর্বস্তরের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান কাজ।

৪. নৈতিকতা: সমাজে ইসলামী নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়।

৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ইসলামিক নীতির ভিত্তিতে গঠন করা হয়, যেখানে সবার সাথে ন্যায্যতা, সম্মান ও শান্তির ভিত্তিতে সম্পর্ক বজায় রাখা হয়।

ইসলামী রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে খোলাফায়ে রাশেদীন (প্রথম চার খলিফার শাসনকাল) শাসিত মুসলিম সমাজকে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে ইসলামী আইন ও নীতির ভিত্তিতে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হত। এমনকি রাসূল সা. পবরর্তী ফিতনা ও জুলুমতন্ত্রের যুগে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বদা খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,


إِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ

“তোমাদের মধ্যে যারা দীর্ঘ জীবন যাপন করবে (অথবা শেষ যুগে তোমরা যারা জীবন যাপন করবে), সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তোমাদের উপর আমার সুন্নত এবং আমার পরে চার খলিফার সুন্নত (শাসনব্যবস্থা) মেনে চলা আবশ্যক” (আবু দাউদ, হাদীস: ৪৬০৭)

ইসলামী রাষ্ট্রের রোল মডেল প্রথম চার খলিফার শাসনকালের ন্যায় ও ইনসাফ:

১. হযরত আবু বকর (রাঃ) এর শাসনকাল (৬৩২-৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ)

হযরত আবু বকর (রাঃ) ছিলেন প্রথম খলিফা এবং তাঁর শাসনকালে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও ঐক্য রক্ষার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর খিলাফতের প্রথম কাজ হিসেবে মিথ্যা নবীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং জমাকৃত যাকাতের সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করেন। তাঁর শাসনামলে তিনি সবসময়ই সাধারণ মানুষের সাথে ন্যায় ও ইনসাফ বজায় রেখেছেন।

২. হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনকাল (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)

হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনকালকে ইসলামের ইতিহাসে ন্যায় ও ইনসাফের সর্বোচ্চ উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইসলামী আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করেন।

  • বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা: উমর (রাঃ) বিচার ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করেন। তিনি বিচারকদের নিয়োগ দেন এবং তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন যাতে তারা যে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার বিচার করতে পারেন, এমনকি খলিফা নিজেও যদি অভিযুক্ত হন।
  • উমর (রাঃ) এর বিখ্যাত কথোপকথন: একবার এক ব্যক্তিকে উমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করেন, “যদি আমি অন্যায় করি, তাহলে তোমরা কী করবে?” তখন সেই ব্যক্তি বলেন, “আমরা আপনাকে এই তরবারি দিয়ে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবো।” উমর (রাঃ) তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং এই ধরনের কথা বলার জন্য সেই ব্যক্তিকে প্রশংসা করেন। কতটুকু ন্যায় ও ইনসাফ বজায় থাকলে রাষ্ট্রের প্রজা তার শাসককে এভাবে কথা বলার সুযোগ পায়! এটি তাঁর শাসনকালের ন্যায় ও ইনসাফের স্পষ্ট উদাহরণ।
  • সমান অধিকার: উমর (রাঃ) এর শাসনকালে ধনী ও দরিদ্র, শাসক ও প্রজা সবার জন্য একই আইন প্রযোজ্য ছিল। তিনি দৃঢ়তার সাথে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং কারো পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করেননি।

৩. হযরত উসমান (রাঃ) এর শাসনকাল (৬৪৪-৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দ)

হযরত উসমান (রাঃ) এর শাসনকাল ছিল ইসলামের বিস্তৃতি ও সমৃদ্ধির যুগ। তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের ভাষাগত বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনাকে বন্ধ করেন। চূড়ান্তভাবে কুরআন সংকলন করে বিভিন্ন কপি তৈরি করেন এবং তা বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন, যা ইসলামী জ্ঞানের সংরক্ষণে একটি বড় পদক্ষেপ ছিল।

  • অর্থনৈতিক ন্যায্যতা: তাঁর শাসনকালে উসমান (রাঃ) ইসলামী অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি সমাজে অর্থের সুষ্ঠু বণ্টন এবং দরিদ্রদের সহায়তা প্রদানে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
  • পরিষ্কার প্রশাসন: উসমান (রাঃ) প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেন। যদিও তাঁর শাসনকালের শেষের দিকে ইয়াহুদী মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়, তবুও তাঁর প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণ এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।

৪. হযরত আলী (রাঃ) এর শাসনকাল (৬৫৬-৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ)

হযরত আলী (রাঃ) ছিলেন চতুর্থ খলিফা, এবং তাঁর শাসনকাল ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গৃহযুদ্ধের কারণে তাঁর শাসনকাল কঠিন ছিল, তবে তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন।

  • ইনসাফের জন্য দৃঢ়তা: আলী (রাঃ) সকল ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন এবং শাসনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন। তিনি বারবার তাঁর অনুসারীদের ন্যায় ও ইনসাফের পথে চলার নির্দেশ দেন এবং এ ব্যাপারে কোনো আপস করেননি।
  • গৃহযুদ্ধ এবং কৌশল: আলী (রাঃ) গৃহযুদ্ধের সময়ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং পরিস্থিতির কৌশলী ব্যবস্থাপনা করেন। যদিও রাজনৈতিক বিভাজন ছিল, তবুও তিনি ইসলামের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হননি।

খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনকাল ইসলামি শাসনব্যবস্থার একটি আদর্শ উদাহরণ, যেখানে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সমাজ পরিচালিত হয়েছিল। এই শাসকদের মূলনীতি ছিল আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল মানুষের অধিকার রক্ষা করা। এই সময়কাল ইসলামি ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

খোলাফায়ে রাশেদিনের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার ন্যায়-ইনসাফের কিছু ঘটনা:

খোলাফায়ে রাশেদিনের (প্রথম চার খলিফার) শাসনকালে ন্যায় ও ইনসাফের অনেক ঘটনা রয়েছে যা ইসলামী ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত। নিচে রেফারেন্সসহ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করা হলো।

ঘটনা: ১: একবার হযরত উমর (রাঃ) এর ছেলে আবদুল্লাহ (রাঃ) একজন সাধারণ মানুষের সাথে একটি আর্থিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি আদালতে গড়ায় এবং বিচারক উবাইদুল্লাহ ইবনে আল-মাসআদী (রাঃ) উমর (রাঃ) এর ছেলেকে অভিযুক্ত করেন। হযরত উমর (রাঃ) নিজেও কোনো প্রকার পক্ষপাত না করে বিচারকের রায় মেনে নেন এবং শাস্তি কার্যকর করতে বলেন। (ইবনে কাইয়িম আল-জাওযিয়া, আল-তুরুক আল-হুক্মিয়া, Dar al-Maarif edition)

ঘটনা: ২: আঠার হিজরিতে আরব অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখন হযরত উমর (রাঃ) খলিফা ছিলেন। তিনি নিজে খাদ্য ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করেন এবং তাঁর নিজের পরিবারের জন্য নির্ধারিত খাদ্য সবার মতোই সীমিত করেন। তিনি নির্দেশ দেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত না সবার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর নিজের পরিবারও সীমিত খাদ্য গ্রহণ করবে। (ইবনে সাআদ, আল-তাবাকাত আল-কুবরা)

ঘটনা: ৩: হযরত উসমান (রাঃ) এর শাসনকালে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী উঠেছিল, এবং তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তবে, তিনি তাঁর খিলাফতের সময়ে কখনোই রক্তপাত করতে চাননি এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য কোনো কঠোর শাস্তি আরোপ করেননি। উসমান (রাঃ) এর ক্ষমাশীলতা তাঁর শাসনকালের ন্যায় ও ইনসাফের উদাহরণ হিসেবে উল্লিখিত হয়। (ইবনে আবি শাইবা, আল-মুসান্নাফ)

ঘটনা: ৪: একবার হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে একটি ইহুদি ব্যক্তি অভিযোগ আনে যে আলী (রাঃ) তার একটি বর্ম চুরি করেছেন। বিষয়টি আদালতে গড়ায় এবং বিচারক আলী (রাঃ) কে প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য বলেন। আলী (রাঃ) এর কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল না, তাই বিচারক ইহুদি ব্যক্তির পক্ষে রায় দেন। পরে সেই ইহুদি ব্যক্তি ইসলামের ন্যায় বিচার দেখে মুসলমান হয়ে যায় এবং বর্মটি আলী (রাঃ) এর কাছে ফিরিয়ে দেয়। (আল-তাবারী, তারীখ আল-রুসুল ওয়াল মুলুক)

ঘটনা: ৫: হযরত উমর (রাঃ) তাঁর শাসনামলে একটি নীতি চালু করেন যে মজুরি ও যাকাত বিতরণের ক্ষেত্রে শাসক, প্রজা ও কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা কোনো সুবিধা থাকবে না। তিনি বলেন, “কেউই অন্যের থেকে বেশি মজুরি পাওয়ার অধিকার রাখে না, যদি না তা প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনীয় হয়।” এই নীতি তাঁর শাসনামলে ইনসাফের প্রতিফলন ঘটায়। (ইবনে কাছির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া )

কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট:

ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রে এমন শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা, যেখানে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে সমাজের ন্যায়বিচার, সুশাসন, এবং মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা হয়। নিচে কুরআন ও হাদীসের আলোকে রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হলো:

এক. আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসন করা। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট হলো আল্লাহর বিধান শতভাগ বাস্তবায়ন করা।  আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ ، وَفِي آيَةٍ: فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ، وَفِي آيَةٍ: فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُوْنَ

“যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার করে না, তারাই পাপী। অন্য আয়াতে আছে তারেই জালিম। অন্য আয়াতে আছে, তারাই কাফের। (সূরা আল-মায়েদা, ৫: ৪৪, ৪৫, ৪৭)

দুই. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সেখানে পরিপূর্ণ ন্যায় বিচার বজায় থাকবে; যার নমুনা আমরা ইতিপূর্বে খোলাফায়ের রাশিদের সময়কাল থেকে জেনেছি। এই বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُم بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার ও সৎকর্ম করার আদেশ দেন।”(সূরা আন-নাহল, ১৬:৯০) অন্যত্র বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ

“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো, সাক্ষ্য দাও।”(সূরা আন-নিসা, ৪:১৩৫)

রাসূল সা. এর প্রসিদ্ধ একটি হাদীসেও ন্যায়পরায়ন শাসনের তাৎপর্যর বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمْ اللهُ فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ الْإِمَامُ الْعَادِلُ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ رَبِّهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ طَلَبَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ أَخْفَى حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ.

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে দিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন।

১. ন্যায়পরায়ণ শাসক,

২. সে যুবক যার জীবন গড়ে উঠেছে তার প্রতিপালকের ইবাদতের মধ্যে,

৩. সে ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে,

৪. সে দু’ ব্যক্তি যারা পরস্পরকে ভালবাসে আল্লাহর ওয়াস্তে, একত্র হয় আল্লাহর জন্য এবং পৃথকও হয় আল্লাহর জন্য,

৫. সে ব্যক্তি যাকে কোনো উচ্চ বংশীয় রূপসী নারী আহবান জানায়, কিন্তু সে এ বলে প্রত্যাখ্যান করে যে, ‘আমি আল্লাহকে ভয় করি’,

৬. সে ব্যক্তি যে এমন গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে বাম হাত তা জানে না,
৭. সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকর করে, ফলে তার দু’ চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে থাকে।(সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৬০)

তিন. জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো এখানে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে কঠোরভাবে বাধাদানের মাধ্যমে জনসাধারণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। এই বিষয়ে কুরআন সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো-

الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ

“যাদের আমরা পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা দান করি, (তাদের প্রধান দায়িত্ব হলো) তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত গ্রহণ ও সুষ্ঠু বন্টন করে, সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখে।”(সূরা আল-হাজ্জ, ২২:৪১)

চার. সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। সমাজে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। পবিত্র কুরআন সামাজে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উক্ত নির্দেশনার আলোকে ইসলামী রাষ্ট্র তার সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখে। কুরআনে আছে:

وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا

“তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ (বিশৃঙ্খলা) সৃষ্টি করো না, যখন তা সংশোধিত হয়েছে।”(সূরা আল-আরাফ, ৭:৫৬)

সমাজে বিশৃংখলার ব্যাপারে ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশনা হলো-

اِنَّمَا جَزٰٓؤُا الَّذِیۡنَ یُحَارِبُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَسۡعَوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ فَسَادًا اَنۡ یُّقَتَّلُوۡۤا اَوۡ یُصَلَّبُوۡۤا اَوۡ تُقَطَّعَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ اَرۡجُلُهُمۡ مِّنۡ خِلَافٍ اَوۡ یُنۡفَوۡا مِنَ الۡاَرۡضِ ؕ ذٰلِكَ لَهُمۡ خِزۡیٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ.

যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আর যমীনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে বেড়ায় তাদের শাস্তি হল এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা তাদের হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা হবে, অথবা তাদেরকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। এ হল তাদের জন্য দুনিয়াতে লাঞ্ছনা, আর তাদের জন্য আখেরাতে রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা মাইদা: ৩৩)

পাঁচ. সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য নিশ্চিত করা। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো রাষ্ট্রের সম্পদ কতিপয় লোকের হাতে কুক্ষিগত থাকবেনা। বরং রাষ্ট্রের সম্পদ ইনসাফের সহিত সকল স্তরের মানুষের মাঝে বন্টিত হবে। এই ব্যাপারে কুরআনের নির্দেশনা হলো-

كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ

“যাতে ধনসম্পদ তোমাদের ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে।” (সূরা আল-হাশর, ৫৯:৭) অন্য আয়াতে আছে-

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِم بِهَا

“তুমি তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাহ গ্রহণ কর, যা তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশুদ্ধ করবে।” (সূরা আত-তাওবা, ৯:১০৩)

ছয়. স্বেচ্ছাচারিতা নয়; বরং পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ক্ষমতা হাতের পাওয়ার পর মানুষ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ কখনো স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ নেই বরং যথাযত ব্যক্তিবর্গের সাথে, রাষ্ট্রে অবস্থিত সকল গোষ্ঠীর সাথে এবং প্রয়োজনের আলোকে সকল জনসাধারণের সাথে পরার্শমর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ

“তাদের সকল কাজ যেন পরামর্শের মাধ্যমে হয়।” (সূরা আশ-শুরা, ৪২:৩৮) অন্যত্র বলেন,

وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ

“তুমি তাদের (তোমার অধীনস্থদের) সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে পরামর্শ করো “(সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৫৯) রাসূলুল্লাহ (সা.) এই ব্যাপারে বলেছেন:

مَا خَابَ مَنِ اسْتَشَارَ

“যে পরামর্শ করে, সে কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।”(সুনান আত-তিরমিজি, হাদীস: ১৭২৫)

সাত. সু-শিক্ষা ও দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা করা। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো মানুষকে ঐশি আলোয় আলোকিত করা। পরিশুদ্ধ জ্ঞান দ্বারা মানুষের ভিতরের পশুত্বকে নির্মুল করা। কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ

“যেমন আমি তোমাদের মধ্যে একজন রসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনায়, তোমাদের পরিশুদ্ধ করে এবং তোমাদের কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেয়।”(সূরা আল-বাকারাহ, ২:১৫১)

আট. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন ও যুদ্ধ পরিচালনা। একটি ইসলামী রাষ্ট্র তার নিজের আয়ত্তের জনগণের সার্বিক শৃংখলা ও ইসলামী নিয়ম নীতি প্রতিষ্ঠা করার পর তার দায়িত্ব হলো পার্শ্ববর্তী মাজলুম ভূখণ্ডের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। সেখানে যদি বে-ইনসাফি শাসন কিংবা শোষণ নিপীরন চলে অথবা ভিন্ন কোন ভূখণ্ডে মুসলিমরা নির্যাতিত হয়, তাহলে ঐ বেইনসাফি শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। মানুষকে জুলুম থেকে উদ্ধার করা উক্ত ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ

“তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব শক্তি প্রস্তুত করো।” (সূরা আল-আনফাল, ৮:৬০)

নয়. নামাজ ও যাকাতের বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচানো। এটি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম কাজ। কুরআনে উল্লেখিত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান চারটি কাজের মধ্যে এই দুটিই প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে।

الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ

“যাদের আমরা পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা দান করি, (তাদের প্রধান দায়িত্ব হলো) তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত গ্রহণ ও সুষ্ঠু বন্টন করে। (সূরা আল-হাজ্জ, ২২:৪১)

কারণ এই দুটি কাজের মাধ্যেমেই মূলত মানুষকে চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচানো সম্ভব। প্রথমত, নামাজের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে স্পষ্টত বলা হয়েছে-

اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡكَرِ

নিশ্চয়ই সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে। (আনকাবুত: ৪৫)

দ্বিতীয়ত, যাকাতের মাধ্যমে সমাজে মানুষের অর্থনৈতিক সমতা সৃষ্টি হয়। মানুষের মাঝে সম্ভব কুক্ষিগত করার লোভ দূরভিত হয়। ফলে মানুষ নৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার প্রশিক্ষণ লাভ করে।

কুরআন ও হাদীসের আলোকে স্পষ্ট যে, ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্টসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব বৈশিষ্ট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার, শান্তি, এবং সুশাসন নিশ্চিত করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা।

বর্তমান ফিতনা ও জুলুমতন্ত্রের যুগে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা:

বর্তমান ফিতনা ও জুলুমতন্ত্রের যুগে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি সমাজের ন্যায়বিচার, শান্তি, এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। পূর্বে উল্লেখিত ইসলামী রাষ্ট্রের বৈশিষ্টের আলোকে বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তার কিছু কারণ বর্ণনা করা হলো:

১. নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ:

বর্তমান যুগে নৈতিকতার অবক্ষয়, অসৎ কর্ম, এবং অন্যায় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র একটি সমাজে নৈতিকতা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যেখানে মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি এবং পরকালের জবাবদিহিতা থাকবে।

২. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা:

জুলুমতন্ত্র এবং অন্যায় শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ শোষিত হয় এবং তাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষের জন্য সমানভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারো উপর জুলুম বা অবিচার করা হয় না।

৩. অর্থনৈতিক সাম্য ও দারিদ্র্য বিমোচন:

ইসলামী রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সাম্যের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। বর্তমান জগতে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত, সাদাকাহ, এবং অন্যান্য ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ

“তোমাদের ধনীদের সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।” (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:১৯)

৪. শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা:

যুগে যুগে ফিতনা, বিভাজন, এবং সংঘাতের ফলে সমাজে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা, আইন এবং সমাজব্যবস্থায় ইসলামের নীতি অনুসরণ করে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।

৫. ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও সংরক্ষণ:

ইসলামী রাষ্ট্র একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে গঠিত। বর্তমান যুগে ধর্মীয় শিক্ষার অভাব; তাই ইসলামী জ্ঞান বিস্তারের গুরুত্ব অপরিসীম।

৬. আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও সম্পর্ক উন্নয়ন:

ইসলামী রাষ্ট্র শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতিফলন ঘটায়। ইসলামী রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কৌশলী ভূমিকা পালন করে।

৭. মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষা:

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। বর্তমান সমাজে মানুষ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতন, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, যা ইসলামী রাষ্ট্রের নীতির পরিপন্থী।

৮. ফিতনা থেকে বাঁচানো:

ইসলামী রাষ্ট্র মানুষের মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ধর্মীয় ঐক্য বজায় রাখে, যা ফিতনা ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে।

৯. ইবাদতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা:

ইসলামী রাষ্ট্র এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে যেখানে মানুষ আল্লাহর ইবাদত স্বাধীনভাবে করতে পারে। শুধু তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্র তার ভূখন্ডে অবস্থানরত অন্যান্য ধর্মের ধর্মীয় স্বাধীনতাও শতভাগ নিশ্চিত করে। বর্তমান সময়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা অনেক দেশে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

১০. ইসলামী ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ:

ইসলামী রাষ্ট্র ইসলামী ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং মূল্যবোধ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা একটি মুসলিম সমাজের পরিচিতি রক্ষা করে।

উপসংহার:

বর্তমান ফিতনা ও জুলুমতন্ত্রের যুগে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী রাষ্ট্রের মাধ্যমে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার, শান্তি এবং মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, নৈতিকতা, এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

উপরোক্ত বয়ানের আরবী অনুবাদ (সংক্ষিপ্ত ও মূলবক্তব্য)

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ، أَمَّا بُعْدُ . . . . . . . . . . . . . . .

أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامَ

 مَوْضُوعُنَا الْيَوْم: أَهَمِّيَّة وَضَرُورَة الدَّوْلَة الإِسْلَامِيَّة

الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ هِيَ الدَّوْلَةُ تُدَارُ عَلَى أَسَاسِ المَبَادِئِ الإِسْلَامِيَّةِ. يُتِمُّ تَشْكِيلُ النِّظَامِ الحَاكِمِ وَالقَوَانِينِ وَالسِّيَاسَاتِ وَالأَخْلَاقِ فِي هَذِهِ الدَّوْلَةِ وَفْقًا لِلشَّرِيعَةِ الإِسْلَامِيَّةِ. الهَدَفُ الرَّئِيسِيُّ لِلدَّوْلَةِ الإِسْلَامِيَّةِ هُوَ اتِّبَاعُ أَوَامِرِ اللَّهِ وَتَحْقِيقُ العَدْلِ وَالإِنْصَافِ فِي المُجْتَمَعِ.

أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامَ الآن أَنا أُلْقِي أَمَامَكُمْ عَنِ الخَصَائِصِ الأَسَاسِيَّةِ لِلدَّوْلَةِ الإِسْلَامِيَّةِ فِي ضَوْءِ القُرْآنِ وَالسُّنَّةِ:

1.الحُكْمُ بِمُوجِبِ شَرِيعَةِ اللَّهِ:

الخَاصِيَّةُ الأُولَى وَالأَهَمُّ لِلدَّوْلَةِ الإِسْلَامِيَّةِ هِيَ تَطْبِيقُ شَرِيعَةِ اللَّهِ بِشَكْلٍ كَامِلٍ. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ  (سُورَةُ المَائِدَةِ، الآيَة 47)

2. إِقَامَةُ العَدْلِ:

إِقَامَةُ العَدْلِ مِنَ الخَصَائِصِ الأَسَاسِيَّةِ لِلدَّوْلَةِ الإِسْلَامِيَّةِ. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُم بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ .”(سُورَةُ النَّحْلِ، الآيَة 90)

3.ضَمَانُ الأَمْنِ وَالسَّلَامَةِ لِلْمُوَاطِنِينَ:

الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تَعْمَلُ عَلَى ضَمَانِ الأَمْنِ وَالسَّلَامَةِ مِنْ خِلَالِ تَطْبِيقِ الأَوَامِرِ الإِلَهِيَّةِ. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ.”(سُورَةُ الحَجِّ، الآيَة 41)

4. الاِسْتِشَارَةُ فِي اتِّخَاذِ القَرَارَاتِ:

مِنَ الخَصَائِصِ المُهِمَّةِ لِلدَّوْلَةِ الإِسْلَامِيَّةِ هُوَ اِعْتِمَادُ الاِسْتِشَارَةِ فِي اتِّخَاذِ القَرَارَاتِ. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ.”(سُورَةُ الشُّورَىٰ، الآيَة 38)

5. المُسَاوَاةُ الاِجْتِمَاعِيَّةُ وَالاقْتِصَادِيَّةُ:

الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تَضْمَنُ المُسَاوَاةَ الاِجْتِمَاعِيَّةَ وَالاقْتِصَادِيَّةَ بَيْنَ أَفْرَادِ المُجْتَمَعِ. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ.”(سُورَةُ الحَشْرِ، الآيَة 7)

أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامَ الآن أَنا أُلْقِي أَمَامَكُمْ عَنْ ضَرُورَةِ إِقَامَةِ الدَّوْلَةِ الإِسْلَامِيَّةِ فِي ظِلِّ الفِتْنَةِ وَالظُّلْمِ فِي العَصْرِ الحَالِيِّ:

  1. مُكَافَحَةُ الاِنْحِلَالِ الأَخْلَاقِيِّ: فِي العَصْرِ الحَالِيِّ، ازْدَادَ الاِنْحِلَالُ الأَخْلَاقِيُّ وَانْتَشَرَ الظُّلْمُ بِشَكْلٍ كَبِيرٍ. الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ يُمْكِنُهَا تَحْقِيقُ الأَخْلَاقِ وَالقِيَمِ الإِسْلَامِيَّةِ فِي المُجْتَمَعِ.
  2. إِقَامَةُ العَدْلِ: فِي ظِلِّ أَنْظِمَةِ الحُكْمِ الظَّالِمَةِ، يَتَعَرَّضُ النَّاسُ لِلظُّلْمِ وَيَتِمُّ حِرْمَانُهُم مِنَ العَدَالَةِ. الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تَضْمَنُ تَحْقِيقَ العَدَالَةِ لِلْجَمِيعِ.
  3. تَحْقِيقُ المُسَاوَاةِ الاقْتِصَادِيَّةِ: الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تُعَزِّزُ المُسَاوَاةَ الاقْتِصَادِيَّةَ وَتَعْمَلُ عَلَى القَضَاءِ عَلَى الفَقْرِ وَالبِطَالَةِ.
  4. إِرْسَاءُ السِّلْمِ وَالاِسْتِقْرَارِ: الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تَضْمَنُ السَّلَامَ وَالاِسْتِقْرَارَ مِنْ خِلَالِ تَطْبِيقِ القَوَانِينِ وَالنِّظَامِ الإِسْلَامِيِّ.
  5. تَعْزِيزُ التَّعْلِيمِ الإِسْلَامِيِّ: الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تُسَاهِمُ فِي نَشْرِ التَّعْلِيمِ الإِسْلَامِيِّ وَالحِفَاظِ عَلَى التُّرَاثِ الثَّقَافِيِّ الإِسْلَامِيِّ.
  6. حِمَايَةُ حُقُوقِ الإِنْسَانِ: الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تَعْمَلُ عَلَى حِمَايَةِ حُقُوقِ الإِنْسَانِ وَتَحْقِيقِ العَدَالَةِ الاِجْتِمَاعِيَّةِ.
  7. ضَمَانُ حُرِّيَةِ العِبَادَةِ: الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تَضْمَنُ حُرِّيَةَ العِبَادَةِ لِلْجَمِيعِ، وَتُحَافِظُ عَلَى حُقُوقِ الأَدْيَانِ الأُخْرَى.
  8. الحِفَاظُ عَلَى التُّرَاثِ الإِسْلَامِيِّ: الدَّوْلَةُ الإِسْلَامِيَّةُ تُحَافِظُ عَلَى التُّرَاثِ وَالثَّقَافَةِ الإِسْلَامِيَّةِ وَتَعْمَلُ عَلَى نَشْرِهَا.

بَارَكَ اللَّهُ لِي وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيمِ، وَنَفَعَنِي وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيهِ مِنَ الْايَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ. أَقُولُ قَوْلِي هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الْجَلِيل، لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِينَ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرُوه أَنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.

সংকলন ,সম্পাদনা, পরিমার্জন ও আরবী তরজমা: ইমরান মাহমুদ (পিএইচডি গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাবি) পুনর্মূল্যায়ন: মুফতি ইসমাঈল হোসাইন (খতিব ও দাঈ)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More To Explore

Scroll to Top