ভূমিকা: কারবালার ঘটনা ইসলামি ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। হিজরি ৬১ সনের ১০ই মুহাররম, ইরাকের কারবালা প্রান্তরে মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রাঃ) পরিবার-পরিজনসহ শাহাদত বরণ করেন। এই ঘটনা কেবল নির্যাতনের ইতিহাস নয়, বরং সত্যের পক্ষে আপসহীন থাকার এক অনন্য শিক্ষা। নিচে কারবালা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও শিক্ষা বর্ণনা করা হলো।
১. ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতের ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে শুধুমাত্র একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড নয়; বরং এটি একটি গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক সংকটের প্রতিক্রিয়া। হিজরি ৬০ সনে যখন আমির মু‘আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাঃ)-এর মৃত্যু ঘটে, তখন তাঁর পুত্র ইয়াজিদ ইবনে মু‘আবিয়া বর্ষিয়ান সাহাবীদের ও বিশেষ করে মদীনার মুসলিমদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে জোরপূর্বক খেলাফতের ক্ষমতা দখল করে। এই ক্ষমতা ছিল বংশানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত, যা ইসলামী খেলাফতের মৌলিক নীতির পরিপন্থী ছিল।
ক. শাসক ইয়াজিদের বৈধতা সংকট:
ইয়াজিদের চরিত্র, জীবনধারা ও শাসননীতির বিষয়ে সাহাবি ও তাবেয়ীদের এক বিশাল অংশের মধ্যে প্রবল আপত্তি ছিল। তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে: ইবনে কাসীর বলেন: “ইয়াজিদ ছিল মদ্যপানকারী, গানবাজনা ও অসংযমী চরিত্রের অধিকারী।” (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৮)
অতএব, একজন ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ, আল্লাহভীরু খেলাফতের মডেল থেকে ইয়াজিদের শাসন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
খ. ইমাম হুসাইন (রা.)-এর অবস্থান ও নীতিগত সিদ্ধান্ত:
রাসূল (সা.)-এর দৌহিত্র হিসেবে ইমাম হুসাইন (রা.) ছিলেন ইসলামী নেতৃত্বের অন্যতম নৈতিক প্রতীক।
- ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা মানে ছিল অন্যায়ের বৈধতা দেওয়া। তাই তিনি ইয়াজিদের শাসনকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেন নি।
- তিনি মদিনা থেকে মক্কায় গমন করেন—সেখানে অবস্থানকালে কুফাবাসীরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য।
- তাঁরা একযোগে শত শত চিঠি পাঠিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়, যে তাঁরা তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে ও সমর্থন দেবে।
তাবারী বলেন: “হুসাইনের নিকট প্রায় বারো হাজারের অধিক চিঠি পৌঁছেছিল কুফাবাসীদের পক্ষ থেকে।”
(তারিখ উর-রুসুল ওয়াল মুলূক, খণ্ড ৩) এই আমন্ত্রণের ভিত্তিতেই হুসাইন (রাঃ) পরিবার-পরিজন ও সঙ্গীদের নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
গ. ইবনে জিয়াদের ভূমিকা ও বিশ্বাসঘাতকতা:
ইয়াজিদ, হুসাইন (রাঃ)-এর আগমন ঠেকাতে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ-কে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করে।
- তিনি কুফা শহরের গোত্রপতিদেরকে হুমকি, ঘুষ প্রদান এবং ভয় দেখিয়ে কুফাবাসীদের মত পরিবর্তন করান।
- ফলে হুসাইন (রা.) যখন ফুফায় গমন করার উদ্দেশ্যে কারবালায় পৌঁছান, তখন তাঁকে কুফার সাধারণ জনগণ সাহায্য করতে সাহস পায় নি।
এভাবে ইমাম হুসাইন (রাঃ) একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার বলি হন।
কারবালার ঘটনাটি নিছক রাজবংশীয় দ্বন্দ্ব ছিল না; বরং এটি ছিল এক মহান নৈতিক সংগ্রাম। ইয়াজিদের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.) সত্য, ইনসাফ ও খোদাভীতির পতাকা তুলে ধরেছিলেন, যা আজও মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অমূল্য আদর্শ।
২. কারবালার ঘটনাপ্রবাহ
ইসলামের ইতিহাসে কারবালার প্রান্তরে ঘটে যাওয়া ঘটনা কেবল একটি যুদ্ধ নয়—এটি একদিকে নিষ্ঠুরতা ও ক্ষমতার অহংকার, অপরদিকে ন্যায়ের প্রতি অটল নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগের এক মহাকাব্য। হিজরি ৬১ সালের ১০ই মুহাররম, ইরাকের কারবালা নামক বালুকাময় ময়দানে মহানবী (সা.)-এর নাতি ইমাম হুসাইন (রা.) তাঁর পরিবার ও সাথীদের নিয়ে শাহাদত বরণ করেন।
ক. মক্কা থেকে কারবালার পথে যাত্রা:
ইয়াজিদের রাজনৈতিক চাপ ও বাইআত গ্রহণের জন্য জোরাজুরির মুখে ইমাম হুসাইন (রাঃ) মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে আসেন। কুফাবাসীরা তাঁকে চিঠি লিখে আহ্বান জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা তাঁকে খলিফা হিসেবে মেনে নেবে ও সাহায্য করবে। এই আশ্বাসে ভরসা করে তিনি পরিবারসহ কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্রসহ প্রায় ৭২ জন।
খ. মিথ্যা আশ্বাস ও অবরোধের ফাঁদ:
হুসাইন (রাঃ)-এর কুফায় পৌঁছানোর আগেই ইয়াজিদ কুফায় উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নামক কঠোর ও নিষ্ঠুর শাসককে নিযুক্ত করে। ইবনে জিয়াদ জনগণকে ভয় দেখিয়ে হুসাইন (রাঃ)-এর পক্ষ ত্যাগ করান। এবং হুসাইন (রাঃ)-এর প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকীল (রাঃ)—কে শহীদ করে। এই অবস্থায় হুসাইন (রাঃ) কারবালার ময়দানে এসে পৌঁছান, আর কুফাবাসীদের পূর্বের প্রতিশ্রুতি গলে যায় বালুর মতো।
গ. কারবালায় অবস্থান ও পানি বন্ধ:
২রা মহররম থেকে হুসাইন (রা.) ও তাঁর সাথীরা কারবালার প্রান্তরে আটকা পড়েন। ৭ মহররমে উমর ইবনে সাদ-এর নির্দেশে ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়—নারী, শিশু, এমনকি নবজাতক পর্যন্ত তৃষ্ণায় কাতর হতে থাকে।
- আলী আসগর (হুসাইন রা. এর ৬ মাসের শিশু) চরম পিপাসায় কাঁদছিলেন। হুসাইন (রাঃ) তাঁকে কোলের মধ্যে নিয়ে পানি চাইলেন।
- ইয়াজিদের সৈন্য হারমালা তাঁর গলায় তীর নিক্ষেপ করে, এবং শিশুটি নীরবে শহীদ হয়।
ঘ. আশুরার রাত ও শেষ প্রস্তুতি:
৯ মহররম রাতে ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর সাথীদের জড়ো করে বলেন,
“যারা চলে যেতে চাও, তোমাদের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত। ইয়াজিদ শুধু আমাকে চায়। আমি অন্ধকারে তোমাদের চলে যেতে বলছি।”
কিন্তু একজনও তাঁকে ছেড়ে যাননি। সেই রাত ছিল ইবাদত, কান্না, কুরআন তিলাওয়াত ও বিদায়ের রাত।
ঙ. ১০ মুহাররম: রক্তাক্ত সকাল:
সকাল বেলা যুদ্ধ শুরু হয়। হুসাইন (রাঃ)-এর সাথীরা একে একে শহীদ হন।
- প্রথমে হুসাইন রা. এর পুত্র আলী আকবর (১৮ বছর) শহীদ হন।
- ভাই আব্বাস ফোরাত থেকে পানি আনার পথে দুই হাত হারিয়ে শাহাদত বরণ করেন।
- ভ্রাতুষ্পুত্র কাসিম (১৩ বছর), ভগ্নিপতি, সাহাবী—সকলেই একে একে শহীদ হন।
অবশেষে, যখন কেউ আর বেঁচে নেই, হুসাইন (রাঃ) শত্রুর সম্মুখে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেন।
তাঁর মাথায় পাগড়ি, হাতে তলোয়ার, মুখে দুআ—তাঁর শরীরে একে একে ৭০টির বেশি আঘাত লাগে।
শিমর ইবনে জাউশন তাঁকে হত্যা করে, তাঁর পবিত্র মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
চ. বন্দিত্ব ও অপমানের ইতিহাস:
- হুসাইন (রাঃ)-এর মৃতদেহকে ঘোড়ার খুরে পিষে দেওয়া হয়।
- নারীদের হিজাব ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
- পরিবারের নারী সদস্যদেরকে বন্দি করে দামেশকে ইয়াজিদের দরবারে পাঠানো হয়।
৩. নবী (সা.)-এর দৌহিত্র হুসাইন (রা.)-এর বিশেষ মর্যাদা
ইমাম হুসাইন (রাঃ) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ছোট নাতি। তিনি ফাতিমা (রা.) ও আলী (রা.)-এর কনিষ্ঠ পুত্র। রাসূল (সা.) তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তাঁর প্রতি বিশেষ স্নেহ, দোয়া ও মর্যাদা প্রকাশ করতেন। বিশুদ্ধ হাদীসসমূহে এই মর্যাদার অসংখ্য দলিল পাওয়া যায়।
ক. হাসান ও হুসাইন (রা.) জান্নাতি যুবকদের নেতা: হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ
আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “হাসান ও হুসাইন জান্নাতি যুবকদের নেতা।” (তিরমিযী: ৩৭৬৮)
খ. হুসাইন (রা.) ছিল রাসূলের সবচেয়ে প্রিয় নাতি: হাদীসে এসেছে-
أَنَّ يَعْلَى بْنَ مُرَّةَ، حَدَّثَهُمْ أَنَّهُمْ، خَرَجُوا مَعَ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ إِلَى طَعَامٍ دُعُوا لَهُ فَإِذَا حُسَيْنٌ يَلْعَبُ فِي السِّكَّةِ قَالَ فَتَقَدَّمَ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ أَمَامَ الْقَوْمِ وَبَسَطَ يَدَيْهِ فَجَعَلَ الْغُلاَمُ يَفِرُّ هَا هُنَا وَهَا هُنَا وَيُضَاحِكُهُ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ حَتَّى أَخَذَهُ فَجَعَلَ إِحْدَى يَدَيْهِ تَحْتَ ذَقَنِهِ وَالأُخْرَى فِي فَأْسِ رَأْسِهِ فَقَبَّلَهُ وَقَالَ “ حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ أَحَبَّ اللَّهُ مَنْ أَحَبَّ حُسَيْنًا, حُسَيْنٌ سِبْطٌ مِنَ الأَسْبَاطِ ” .
ইয়ালা ইবনু মুররাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাঁকে প্রদত্ত এক আহারের দাওয়াতে রওনা হন। তখন হুসায়ন গলির মধ্যে খেলাধূলা করছিলেন। রাবী বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকেদের অগ্রভাগে এগিয়ে গেলেন এবং তাঁর দু হাত বিস্তার করে দিলেন। বালকটি এদিক ওদিক পালাতে থাকলো এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হাসাতে হাসাতে ধরে ফেলেন। এরপর তিনি তাঁর এক হাত ছেলেটির চোয়ালের নিচে রাখলেন এবং অপর হাত তার মাথার তালুতে রাখলেন, অতঃপর তাকে চুমা দিলেন এবং বললেনঃ হুসায়ন আমার এবং আমি হুসায়নের। যে ব্যাক্তি হুসায়নকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবাসেন। হুসায়ন আমার নাতিদের অন্যতম। (ইবনে মাজাহ: ১৪৪)
অপর হাদীসে এসেছে-
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي نُعْمٍ، أَنَّ رَجُلاً، مِنْ أَهْلِ الْعِرَاقِ سَأَلَ ابْنَ عُمَرَ عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ يُصِيبُ الثَّوْبَ فَقَالَ ابْنُ عُمَرَ انْظُرُوا إِلَى هَذَا يَسْأَلُ عَنْ دَمِ الْبَعُوضِ وَقَدْ قَتَلُوا ابْنَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَسَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ “ إِنَّ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ هُمَا رَيْحَانَتَاىَ مِنَ الدُّنْيَا ” .
আবদুর রহমান ইবনু আবী নুম (রহঃ) হতে বর্ণিত আছে এক ইরাকবাসী মাছির রক্ত কাপড়ে লাগলে তার বিধান প্রসঙ্গে ইবনু উমার (রাযিঃ)-এর কাছে জানতে চায়। ইবনু উমার (রাযিঃ) বললেন, তোমরা তার প্রতি লক্ষ্য কর, সে মাছির রক্ত প্রসঙ্গে প্রশ্ন করছে। অথচ তারাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পুত্রকে (নাতি হুসাইন) হত্যা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি বলতে শুনেছিঃ আল-হাসান ও আল-হুসাইন দু’জন এই পৃথিবীতে আমার দুটি সুগন্ধময় ফুল। (তিরমিজি: ৩৭৭০)
গ. হাসান ও হুসাইন রা. কে স্বয়ং আল্লাহই ভালবাসতেন: যেহেতু রাসূল সা. আল্লাহর কাছে বিশেষভাবে দুআ করেছেন যেন আল্লাহ হুসাইন রা.কে ভালবাসেন। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, হুসাইন রা.কে ভালবাসতেন স্বয়ং আল্লাহ নিজেই। হাদীসে এসেছে-
عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ كَانَ يَأْخُذُهُ وَالْحَسَنَ وَيَقُوْلُ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا
উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এবং হাসান (রাঃ)-কে এক সঙ্গে কোলে তুলে নিয়ে বলতেন, হে আল্লাহ্! আমি এদের দু’জনকে ভালবাসি, আপনিও এদেরকে ভালবাসুন। (বুখারি: ৩৭৪৭)
৪. কারবালার শিক্ষা
কারবালার ঘটনা শুধু শোক নয়—এটি এক মহান আত্মত্যাগ, নেতৃত্ব, ও সত্য প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত। ইমাম হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদত আমাদের এমন কিছু চিরন্তন শিক্ষা দেয়, যা প্রতিটি যুগে মুসলিম উম্মাহর জন্য পথনির্দেশক।
ক. সত্য ও ইনসাফের পথে আপসহীন থাকা:
ইমাম হুসাইন (রাঃ) অন্যায় ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকের কাছে মাথানত না করে জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ন্যায়বিচারের পথে অটল ছিলেন। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا كُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلّٰهِ وَ لَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِكُمۡ
“হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফের উপর অবিচল থাকো এবং আল্লাহর সাক্ষ্য প্রদান করো, যদিও তা তোমাদের নিজের বিপক্ষে হয়…” (আন-নিসা: ১৩৫)
খ. অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ঈমানের নিদর্শন:
ইয়াজিদের খেলাফত স্বৈরাচারী ও ব্যক্তিগতভাবে ইয়াজিদ ইসলামবিরোধী ছিল। হুসাইন (রা.) তা প্রতিরোধ করেই শহীদ হন। হাদীসে এসেছে-
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ ” .
“তোমাদের কেউ যদি অন্যায় কাজ দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে; না পারলে মুখ দিয়ে; না পারলে মনে ঘৃণা করে—এটাই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।” (সহীহ মুসলিম: ৪৯) হুসাইন (রাঃ) সেই সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করে জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করেন।
গ. সত্যের পক্ষে অটল থাকা তথা ধৈর্যের আদর্শ:
কারবালায় হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর পরিবার পানিশূন্য, খাবারবিহীন অবস্থায় রোদের মধ্যে সঠিক আদর্শের জন্য নিজেদের জীবন দান করেন। এটি সত্যের পক্ষে অটল থাকা বা ধৈর্যের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। পবিত্র কুরআনে এসেছে-
اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوۡنَ اَجۡرَهُمۡ بِغَیۡرِ حِسَابٍ
“নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদেরকে তাদের প্রতিদান পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হবে বিনা হিসেবে।” (সূরা আজ-জুমার: ১০)
ঘ. নেতৃত্বে তাকওয়া ও যোগ্যতার গুরুত্ব:
হুসাইন (রা.) দেখিয়েছেন, নেতৃত্ব কেবল বংশের নয়; এটি নৈতিকতা ও তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। অন্যথায় নীতিবান ও সৎ শাসন ব্যবস্থার জন্য লড়াই করতে হবে। অসৎ শাসকের সাথে আপোষ কিংবা আনুগত্য করে নয় বরং অসৎ নেতৃত্বকে দূর করে সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ঙ. বাহ্যিক বিজয় লাভ প্রকৃত বিজয় নয় বরং নীতির বিজয়ই প্রকৃত বিজয়:
কারবালায় হুসাইন (রাঃ) মাত্র ৭২ জন সাথী নিয়ে হাজারো সৈন্যের মুখোমুখি হন। তিনি বাহ্যিক হিসাবে তখন পরাজয় লাভ করেন কিন্তু নীতিগতভাবে পৃথিবীর ইতিহাসে হুসাইন (রা.)ই প্রকৃত বীর ও চূড়ান্ত বিজয়ী। ইয়াজিদের বাহ্যত দৃষ্টিতে বড় দলটিই পরাজিত শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
كَمۡ مِّنۡ فِئَۃٍ قَلِیۡلَۃٍ غَلَبَتۡ فِئَۃً كَثِیۡرَۃًۢ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ
“কতই না ক্ষুদ্র দল রয়েছে, যারা আল্লাহর অনুমতিতে বিশাল দলকে পরাজিত করেছে! আল্লাহ সবরকারীদের সাথেই আছেন” (বাকারা: ২৪৯)
চ. জনতার প্রতিশ্রুতি নয়, আল্লাহর উপর ভরসা রাখা উচিত:
কুফাবাসীরা শুরুতে ইমাম হুসাইন (রা.)-কে সমর্থন করলেও পরে সবাই তাঁকে ছেড়ে যায়। কিন্তু হুসাইন রা. একমাত্র আল্লাহর উপরই নির্ভর করে তাঁর গন্তব্যে অটল ও অবিচল ছিলেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ مَنۡ یَّتَوَكَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ
“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (আত-তালাক: ৩)
৫. কারবালার প্রকৃত চেতনা বনাম ভুল চেতনা
কারবালা একটি মহৎ আত্মত্যাগ ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ইতিহাসের এই মহত্তম অধ্যায়কে বহু ক্ষেত্রে আবেগনির্ভর, শরিয়তবিরোধী ও বিদআতমূলক প্রথার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এই অংশে তুলে ধরা হলো—কারবালার আসল বার্তা এবং সময়ের সঙ্গে গড়ে ওঠা বিকৃত ধারণা।
ক. প্রকৃত চেতনা: ঈমান, তাকওয়া ও আত্মত্যাগের আদর্শ
হযরত হুসাইন (রাঃ) আমাদের শিখিয়ে গেছেন—
- অন্যায় শাসকের কাছে মাথানত নয়
- সত্যের পক্ষে অবস্থান, যদিও সংখ্যায় কম হয়
- পরিবার, সন্তান, জীবন—সবকিছু আল্লাহর পথে বিলিয়ে দেওয়া যায়
- আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করেই প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়ানো যায়
খ. ভুল ব্যাখ্যা ও বিদআতমূলক আচরণ
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাকে ঘিরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু সংস্কার ও লোকাচার গড়ে উঠেছে, যা ইসলামি শরিয়তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন:
❌ মাতম ও বুকে আঘাত করা:
- আশুরা উপলক্ষে অনেক স্থানে বুক চাপড়ানো, রক্ত ঝরানো, শোক মিছিল করা হয়—যা শরিয়ত সম্মত নয়।
- ইমাম হুসাইন (রা.) আত্মত্যাগের মাধ্যমে জাগরণ চেয়েছিলেন, কান্না নয়। রাসূল (সা.) বলেন: আবদুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি (মৃতের জন্য) গাল চাপড়াবে, জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলবে অথবা জাহিলী যুগের মত বিলাপ করবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। (মুসলিম: ১৮৭)
❌ আশুরাকে কেবল “শোক দিবস” বানিয়ে ফেলা:
- আশুরা কেবল কারবালার জন্য নয়; এ দিনে হজরত মূসা (আ.) ফেরাউনের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন—রাসূল (সা.) এ দিন রোজা রাখতেন। (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪)
❌ হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতকে কেবল রাজনৈতিক বিদ্রোহ বলা:
- ইমাম হুসাইন (রাঃ) বিদ্রোহ করেননি; বরং তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিয়েছেন—যা ছিল ইসলামি নেতৃত্বের আদর্শ রক্ষা।
গ. একনজরে কারাবালার প্রকৃত চেতনা বনাম ভুল চেতনা
প্রকৃত শিক্ষা | ভুল ব্যাখ্যা |
তাকওয়া, আত্মত্যাগ, ঈমান | আবেগ, মাতম, চিৎকার |
সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ | বাৎসরিক শোকানুষ্ঠান |
মুসলিম ঐক্য, নেতৃত্বের বিশুদ্ধতা | বিভাজন, ফেরকা-ভিত্তিক বিদ্বেষ |
শাসকের অন্যায়ের সাথে আপোস না করা; প্রয়োজনে আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া | শাসকের অন্ধ আনুগত্য, মানব-পূজা ও অতিরিক্ত মহিমা আরোপ |
উপসংহার:
ইমাম হুসাইন (রাঃ) চেয়েছিলেন জাগরণ, তাকওয়া ও নেতৃত্বের বিশুদ্ধতা—অথচ আমরা অনেক সময় তাঁকে আবেগ, মাতম আর বাহ্যিক শোকে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। কারবালার প্রকৃত শিক্ষা হলো আত্মসংযম, দ্বীনের উপর অটলতা এবং সত্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়া। আমরা যদি এই আদর্শে ফিরে আসি, তবে ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও নেতৃত্বে একটি নবজাগরণ ঘটবে—এটাই হুসাই রা. এর প্রকৃত জয়।
উপরোক্ত বয়ানের আরবী অনুবাদ (সংক্ষিপ্ত ও মূলবক্তব্য)
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ، أَمَّا بُعْدُ . . . . . . . . . . . . . . .
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ – مَوْضُوعُنَا اليَوْمِ : تَارِيخُ وَدُرُوسُ كَرْبَلَاءَ
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ الآنَ أُلْقِي أَمَامَكُمْ عَنْ فَضِيْلَةِ شَهِيْدِ كَرْبَلَاءَ إِمَامِنَا حُسَيْن رَضِيَ اللهُ عَنْهُ:
اَلْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا) سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ: كَمَا وَرَدَ فِي الْحَدِيثِ: عَنْ أَبِي سَعِيدٍ قَالَ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ.
كَانَ الْحُسَيْنُ (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ) أَحَبَّ حَفِيدٍ لِلنَّبِيِّ (صَلَّى اَللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ) : كَمَا وَرَدَ فِي الْحَدِيثِ: أَنَّ يَعْلَى بْنَ مُرَّةَ، حَدَّثَهُمْ أَنَّهُمْ، خَرَجُوا مَعَ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ إِلَى طَعَامٍ دُعُوا لَهُ فَإِذَا حُسَيْنٌ يَلْعَبُ فِي السِّكَّةِ قَالَ فَتَقَدَّمَ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ أَمَامَ الْقَوْمِ وَبَسَطَ يَدَيْهِ فَجَعَلَ الْغُلاَمُ يَفِرُّ هَا هُنَا وَهَا هُنَا وَيُضَاحِكُهُ النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ حَتَّى أَخَذَهُ فَجَعَلَ إِحْدَى يَدَيْهِ تَحْتَ ذَقَنِهِ وَالأُخْرَى فِي فَأْسِ رَأْسِهِ فَقَبَّلَهُ وَقَالَ “ حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ أَحَبَّ اللَّهُ مَنْ أَحَبَّ حُسَيْنًا, حُسَيْنٌ سِبْطٌ مِنَ الأَسْبَاطِ ”
ج. أَحَبَّ اللَّهُ أَيْضًا الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ (رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ) : كَمَا جَاءَ فِي الحَدِيْثِ: عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ كَانَ يَأْخُذُهُ وَالْحَسَنَ وَيَقُوْلُ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامُ الآنَ أُلْقِي أَمَامَكُمْ عَنْ دُرُوسُ كَرْبَلَاءَ: مِنْهَا:
أَوَّلًا: اَلثَّبَاتُ عَلَى الْحَقِّ وَالْعَدْلِ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى- یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا كُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلّٰهِ وَ لَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِكُمۡ.
ثَانِيًا: الِاحْتِجَاجُ عَلَى الظُّلْمِ مِنْ عَلَامَاتِ الْإِيمَانِ: كَمَا جَاءَ فِي الحديثِ: مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ ” .
ثَالِثًا. اَلثَّبَاتُ عَلَى الصَّبْرِ لِتَأْسِيْسِ الْحَقِّ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى- اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوۡنَ اَجۡرَهُمۡ بِغَیۡرِ حِسَابٍ.
رَابِعًا: النَّصْرُ الظَّاهِرِيُّ لَيْسَ هُوَ النَّصْرُ الْحَقِيقِيُّ، بَلْ اَلنَّصْرَ الْحَقِيقِيَّ هُوَ النَّصْرُ المَنْشُودُ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى- كَمۡ مِّنۡ فِئَۃٍ قَلِیۡلَۃٍ غَلَبَتۡ فِئَۃً كَثِیۡرَۃًۢ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ.
خَامِسًا: يَنْبَغِي التَّوَكُّلُ عَلَى اللَّهِ، لَا عَلَى النَّاسِ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى-وَ مَنۡ یَّتَوَكَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ.
بَارَكَ اللَّهُ لِي وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيمِ، وَنَفَعَنِي وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيهِ مِنَ الْايَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ. أَقُولُ قَوْلِي هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الْجَلِيل، لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِينَ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرُوه أَنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
সংকলন, সম্পাদনা, পরিমার্জন ও আরবী তরজমা: ইমরান মাহমুদ (পিএইচডি গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাবি)
পুনর্মূল্যায়ন: মুফতি ইসমাঈল হোসাইন (খতিব ও দাঈ)