প্রস্তুতকারক: মুহাম্মাদ নাফিস খোন্দকার
আজকের ব্যস্ত পৃথিবীতে জীবনের যে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির কথা আমরা সহজেই ভুলে যাই তা হল আমাদের স্বাস্থ্য। দৈনন্দিন খাবারের প্রতি একটু মনোযোগী হলে আমরা একটি সুস্থ জীবন গঠন করতে পারি। আসুন কীভাবে আপনি আপনার দেহকে পুষ্টিসমৃদ্ধ রাখার জন্য সহজ কিন্তু শক্তিশালী উপায় বেছে নিতে পারেন এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য দরকারী বিষয়গুলি সম্পর্কে জানি।
সুষম খাদ্যের উপাদান:
আপনার শরীরকে একটি সূক্ষ্ম সুরক্ষিত যন্ত্র হিসাবে কল্পনা করুন, আর আপনি যে খাবার খান তা এর জ্বালানী হিসাবে। এই দেহযন্ত্র মসৃণভাবে চালানোর জন্য প্রয়োজন সুষম খাদ্য। এর অর্থ হল সমস্ত খাদ্য গ্রুপ থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাবার প্রতিদিনের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করা। সুষম খাদ্যের মৌলিক উপাদান ৭ টি – প্রোটিন, শর্করা, স্নেহ, পানি, ভিটামিন, খনিজ লবণ আর ডায়েটারি ফাইবার।
১। প্রোটিন বা আমিষ:
প্রোটিন আমাদের দেহ গঠন, ক্ষয়পূরণ ও পরিচালনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোষের গঠনগত উপাদান হিসেবে কাজ করে প্রোটিন। রক্তের হিমোগ্লোবিন এক ধরণের প্রোটিন, যা রক্তের মধ্যে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বাহক হিসেবে কাজ করে। দেহের হাজারো জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রভাবক হিসেবে কাজ করা এনজাইম, রোগপ্রতিরোধতন্ত্রের ইমিউনোগ্লোবিউলিন ও অনেক হরমোন হচ্ছে প্রোটিন। কন্ট্রাক্টাইল প্রোটিন পেশী সঙ্কোচনে সাহায্য করে। প্লাজমা প্রোটিন রক্তের আয়তন ঠিক রাখে। রক্ত জমাট বাঁধতে প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। প্রোটিন বাফার হিসেবে কাজ করে রক্তের pH নিয়ন্ত্রণ করে যা জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য।
উৎস: মাছ, মাংস, ডিম দুধ, মটরশুটি, ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি।
২। কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা:
দেহ পরিচালনায় প্রয়োজনীয় শক্তির প্রধান উৎস হল শর্করা। মস্তিষ্কের একমাত্র ফুয়েল হচ্ছে গ্লুকোজ। ডিএনএ তৈরিতে দরকার হয় রাইবোজ যা একটি শর্করা। প্রোটিন ও স্নেহ বিপাকে শর্করা সাহায্য করে। লিভারে গ্লাইকোজেন তৈরি করে যা দেহে শক্তির জমানো উৎস হিসেবে থাকে। রোযা রাখলে বা দীর্ঘক্ষণ খাবার না খেলে এই গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজ তৈরি হয়, যা দেহের ফুয়েল হিসেবে কাজ করে। কোষঝিল্লির অন্যতম গাঠনিক উপাদান হল শর্করা। লিভারের মাধমে শর্করা দেহের টক্সিন নিষ্ক্রিয় করে। এছাড়াও কার্বোহাইড্রেট দেহের প্রয়োজন অনুসারে প্রোটিন, স্নেহ ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়ে এগুলোর ঘাটতি পূরণ করে।
উৎস: ভাত, আটা, দুধ, আলু, চিনি ইত্যাদি।
৩। স্নেহ বা লিপিড (ফ্যাট):
খাবারের স্নেহ অংশ শক্তির উৎস ও ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। ইসেনশিয়ালত) ফ্যাটি এসিড, যা একমাত্র খাদ্যের মাধ্যমেই পাওয়া যায় – ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন দেহে শোষণ করতে প্রয়োজন। ফ্যাট ত্বকের নিচে থার্মাল ইন্সুলেটর (তাপ রোধক) এবং স্নায়ুতন্ত্রে ইলেক্টিক্যাল ইন্সুলেটর হিসেবে কাজ করে। ইলেক্টিক্যাল ইন্সুলেটর স্নায়ু সংকেত দ্রুত পরিবহনে সাহায্য করে। থার্মাল ইন্সুলেটর দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বজায় রাখে। স্নেহ জাতীয় খাবার ভিটামিন ডি ও স্টেরয়েড হরমোনের মাতৃ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও সারফ্যাকট্যান্ট হিসেবে কাজ করে ফুসফুসের চুপসে যাওয়া রোধ করে।
উৎস: ডিম, মাংস, মাছ, বাদাম, দুধ ও দুধের তৈরি খাবার (মাখন, ঘি ইত্যাদি)। ভেজিটেবল অয়েল (সয়াবিন, নারকেল, সরিষার তেল ইত্যাদি) মাছের তেল, কড লিভার অয়েল, সয়াবিন তেল ইত্যাদি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট দেহের জন্য উপকারী। অন্যদিকে চর্বি, পাম অয়েল, ডালডা ইত্যাদি স্যাচুরেটেড ফ্যাট হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
সাধারণত এই তিনটি উপাদান তথা শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট ৪ : ১ : ১ অনুপাতে খেতে হয়।
৪। পানি:
আমাদের দেহের ৫৫-৬০% পানি। সকল জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য পানি অপরিহার্য। পানি আমাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। বিপাকীয় বর্জ্য পদার্থ, বিষাক্ত দ্রব্য পানির মাধ্যমে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ২ লিটার পানি পান করা উচিত।
৫। ভিটামিন:
আমাদের দেহে ভিটামিন খুবই সামান্য পরিমাণে লাগে। কিন্তু এর গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেহের অপটিমাম কার্যক্ষমতা, বৃদ্ধি ও পরিচালনা নিশ্চিত করে ভিটামিন। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অনেক প্রাণঘাতী রোগ ভিটামিনের অভাবে হয়ে থাকে। পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন (ভিটামিন সি ও বি কমপ্লেক্স) আমাদের দেহ থেকে মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়। তাই এগুলো প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করতে হয়। অন্যদিকে ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিন (ভিটামিন এ, ডি, ই, কে) আমাদের দেহে বেশ অনেকদিক ধরে জমা থাকতে পারে। এগুলো প্রয়োজনানুসারে গ্রহণ করতে হয়।
উৎস: ফলমূল, রঙিন শাকসবজি, কাঁচামরিচ, টমেটো, লেবু ইত্যাদি।
৬। খনিজ লবণ:
স্নায়ু সংকেত পরিবহণ, পেশী সঙ্কোচন, হৃৎপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণ, রক্তের আয়তন নিয়ন্ত্রণ সহ শত শত গুরুত্বপূর্ণ কাজে খনিজ পদার্থের প্রয়োজন। এর অভাবে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসকষ্ট, হাইপোথাইরয়ডিজম, সেরেব্রাল ইডেমা সহ আরও অনেক রোগ। এমনকি এর অভাবে কোমা অথবা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
উৎস: খাবার লবণ, ফলমূল, সবজি ইত্যাদি।
৭। ফাইবার:
ফাইবার মূলত শাকে বেশি থাকে। সুস্থ পরিপাকতন্ত্রের জন্য ফাইবার খুবই প্রয়োজন। এগুলো পানি ধারণের মাধ্যমে মলকে পিচ্ছিল করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে। ফাইবার মলের মাধ্যমে খারাপ কোলেস্টেরল বের করে দেয়। গ্লুকোজ টলারেন্স বাড়িয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। টক্সিন ও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ দেহে শোষণ হওয়া থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও এটি কোলন ক্যান্সার, পাইলস ও স্থূলতার ঝুঁকি কমায়। তবে অতিরিক্ত ফাইবার খেলে ডায়েরিয়া ও ফ্ল্যাটুলেন্স হতে পারে এবং কিছু খনিজ পদার্থের শোষণ বাধাগ্রস্থ হয়।
খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী:
উল্লিখিত সুষম খাদ্যের উপাদানগুলো আমাদের দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এগুলোর কাজ সম্পর্কে অবগত হলে এদের তাৎপর্য বুঝা যায়। সুস্থ জীবনের জন্য উপরে বর্ণিত তথ্যের আলোকে খাওয়ার সময় নিচের বিষয়গুলি খেয়াল করা জরুরী।
খাদ্যোপাদানের ভাগ:
খাবারের প্লেট কয়েকটি ভাগে ভাগ করুন। প্লেটের অর্ধেক থাকবে শাকসবজি। এক-চতুর্থাংশ বরাদ্দ প্রোটিনের জন্য আর এক-চতুর্থাংশ ভাত বা রুটি (শর্করা)। এই সহজ ভিজুয়াল গাইডটি অতিরিক্ত খাওয়া থেকে রক্ষা করে। খাবারে থাকা তেল স্নেহের চাহিদা মিটাবে।
পানি পান অপরিহার্য:
পানি হজমে সাহায্য করে। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ত্বক উজ্জ্বল রাখে। প্রতিদিন কমপক্ষে ২ লিটার পানি পান করার চেষ্টা করুন। আর যদি শারীরিকভাবে বেশি একটিভ হন বা গরম আবহাওয়া থাকে তাহলে আরও বাড়িয়ে পান করুন।
স্মার্ট স্ন্যাকস:
স্ন্যাকিং ছাড়া আমাদের চলেই না। বুদ্ধির সাথে স্ন্যাক আইটেম বেছে নিন। চিপস, জাঙ্ক ফুড বা চিনি জাতীয় স্ন্যাকের বদলে ফল, বাদাম অথবা দই খেতে পারেন। এগুলো ক্ষুধাও নিবারণ করবে আবার গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানও সরবরাহ করবে।
অতিরিক্ত চিনি বা লবণ পরিহার করুন:
অতিরিক্ত চিনি বা লবণ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। সুস্থ, রোগমুক্ত একটি দেহ পেতে মিষ্টি জাতীয় খাবার, কোমল পানীয়, ক্যান্ডি, আর অতিরিক্ত প্রসেস করা খাবার কম খেতে হবে। খাবারের স্বাদের জন্য এগুলোর পরিবর্তে প্ল্যান্ট বেজড মসলা ব্যবহার করুন।
মনে রাখবেন, এটা কঠিন ডায়েটের ব্যাপার নয়। বরং এটা প্রতিদিনের খাবার বাছাইয়ে উপরে বর্ণিত পুষ্টিজ্ঞান কাজে লাগানো। সঠিক উপাদান দিয়ে শরীরের যত্ন নিলে আপনি একটি স্বাস্থকর, রোগমুক্ত ও সুখী জীবন যাপন করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ্।
লেখক: শিক্ষার্থী, এমবিবিএস ২য় বর্ষ, ইবরাহিম মেডিকেল কলেজ (বারডেম)