ভূমিকা:
পর্দা বা হিজাব মানবসমাজের নৈতিক শৃঙ্খলা ও ব্যক্তিগত মর্যাদার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল একটি পোশাকের বিধান নয়, বরং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ এবং সামাজিক পরিবেশের শুদ্ধতা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুশাসন। ইসলামী শরীয়তে পর্দার নির্দেশনা ব্যক্তির আত্মসম্মান, পরিবারিক বন্ধন এবং সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নির্ধারিত হয়েছে।
বর্তমান সময়ে সামাজিক অনাচার, নৈতিক অবক্ষয় ও অবাধ্যতার যে প্রবণতা সমাজকে গ্রাস করছে—তার পেছনে অন্যতম কারণ হল পর্দাহীনতা ও শালীনতার অবমূল্যায়ন। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, যৌন হয়রানি, পরকিয়া, পারিবারিক ভাঙনসহ নানা সামাজিক ব্যাধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা মানবসভ্যতার সুস্থ বিকাশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসলামে পর্দার নির্দেশনা মানব প্রকৃতির অন্তর্নিহিত প্রবণতা ও সমাজের শান্তি রক্ষার লক্ষ্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বাস্তবধর্মীভাবে নির্ধারিত। পর্দার মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য একটি নিরাপদ ও শালীন জীবনধারা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা সামাজিক অপরাধ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই আলোচনায় আমরা বিশ্লেষণ করব- পর্দার বিধান, পর্দার প্রকৃত তাৎপর্য কী, কীভাবে পর্দা সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে, এবং আধুনিক চ্যালেঞ্জের মুখে পর্দার গুরুত্ব কেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়নে কীভাবে পর্দা-সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে, সে বিষয়েও দিকনির্দেশনা প্রদান করা হবে।
পর্দার সংজ্ঞা ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি:
“পর্দা” শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো আচ্ছাদন, আবরণ বা আড়াল। ইসলামী পরিভাষায় পর্দা বলতে বোঝানো হয়—নারী ও পুরুষের মধ্যে এমন একটি শালীনতা ও সংযমপূর্ণ আচরণ ও পোশাকের বিধান, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের পবিত্রতা ও সামাজিক নৈতিকতা রক্ষায় সহায়ক।
পর্দা শুধু বাহ্যিক পোশাকের সীমাবদ্ধ বিধান নয়; এটি দৃষ্টির সংযম, কথোপকথনের ভদ্রতা, চলাফেরার মার্জিত রূপ ও সমগ্র জীবনশৈলীর একটি অংশ।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্দার গুরুত্ব:
ইসলাম মানব প্রকৃতির সূক্ষ্ম দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে পর্দার বিধান দিয়েছে, যাতে সমাজে নৈতিকতা, শালীনতা ও পারস্পরিক সম্মান বজায় থাকে। নিচে পর্দার গুরুত্ব তুলে ধরা হলো-
১. পর্দার মাধ্যমে অন্তর পবিত্র হয়: এই বিধানের অনুসরণের মাধ্যমেই হৃদয়-মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। পর্দার এই সুফল স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَ قُلُوْبِهِنَّ
এই (পর্দার) বিধান তোমাদের (পুরুষ) ও তাদের (নারী) অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (আহযাব: ৫৩) সুতরাং মানবসমাজকে পবিত্র ও পঙ্কিলতামুক্ত রাখতে পর্দা-বিধানের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমান সমাজের যুবক ও তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা ও নারীজাতির নিরাপত্তার জন্য পর্দা-বিধানের পূর্ণ অনুসরণ এখন সময়ের দাবি।
২. পর্দার মাধ্যমে সমাজ ও মানুষের সামগ্রীক জীবন পবিত্র হয়: আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে পর্দার একটি বিধান বর্ণনাপূর্বক বলেন,
ؕ ذٰلِكَ اَزۡكٰی لَهُمۡ
এটা মানবজাতির জন্য অধিক শুদ্ধতার মাধ্যম। (নূর: ৩০)
৩. পর্দা নারীদের নিরাপত্তা জোরদার করে: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,
یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤی اَنْ یُّعْرَفْنَ فَلَا یُؤْذَیْنَ ؕ وَ كَانَ اللّٰهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের একটি অংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (আহযাব: ৫৯)
৪. পর পুরুষ কিংবা পর নারীর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া থেকে বিরত থাকলে অন্তরের ঈমানের স্বাদ পাওয়া যায়: হাদীসে এসেছে-
إِنَّ النَّظْرَةَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ إِبْلِيسَ مَسْمُومٌ، من تركَه خوفًا من اللهِ آتاهُ اللهُ إيمانًا يجدُ حلاوتَه في قلبِه.
পর নারী কিংবা পর পুরুষের দিকে দৃষ্টি হলো ইবলিশের বিষাক্ত তীরের ন্যায়। যে এই অবৈধ দৃষ্টি আল্লাহর ভয়ে নিজেকে রক্ষা করবে তার মনে এমন ঈমান দান করবেন; যার স্বাদ অন্তরে অনুভব করবে (হাকেম: ৭৮৭৫)
পর্দার বিধান
১. পুরুষ ও নারী উভয়েই তাদের দৃষ্টি অবনত রাখবে: পবিত্র কুরআনে প্রথমেই পুরুষ জাতিকে দৃষ্টি অবনত করার ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছে অতপর নারীদেরকেও অনুরূপ নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِكَ اَزۡكٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ– وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ
মু’মিনদের বলুন, তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, এটাই তাদের জন্য বেশি পবিত্র, তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে আল্লাহ খুব ভালভাবেই অবগত। আর ঈমানদার নারীদেরকে বলে দিন, তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে। (নূর: ৩০-৩১) হাদীসে এসেছে-
إِنَّ النَّظْرَةَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ إِبْلِيسَ مَسْمُومٌ
পর নারী কিংবা পর পুরুষের দিকে দৃষ্টি হলো ইবলিশের বিষাক্ত তীরের ন্যায়। (হাকেম: ৭৮৭৫)
অপর হাদীসে এসেছে-
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، قَالَتْ: كُنْتُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعِنْدَهُ مَيْمُونَةُ، فَأَقْبَلَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ وَذَلِكَ بَعْدَ أَنْ أُمِرْنَا بِالْحِجَابِ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: احْتَجِبَا مِنْهُ، فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَلَيْسَ أَعْمَى لَا يُبْصِرُنَا، وَلَا يَعْرِفُنَا؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَفَعَمْيَاوَانِ أَنْتُمَا، أَلَسْتُمَا تُبْصِرَانِهِ.
উম্মু সালামাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছিলাম এবং তাঁর নিকট মাইমূনাহ (রাঃ)-ও ছিলেন। এ সময় ইবনু উম্মু মাকতূম (রাঃ) (অন্ধ সাহাবী) এলেন। ঘটনাটি আমাদের উপর পর্দার হুকুম নাযিলের পরের। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমরা তার থেকে আড়ালে চলে যাও। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! সে কি অন্ধ নয়? সে তো আমাদের দেখতে ও চিনতে পারছে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ যদিও সে অন্ধ কিন্তু তোমরা উভয়ে কি তাকে দেখছো না? (আবু দাউদ: ৪১১২)
২. নারীগণ শালীন বোরখা পরিধান করবে: নারীগণ প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে তাদের শরীরকে অতিরিক্ত কাপড় (বোরখা) দিয়ে ঢেকে নিবেন, যেন তাদের শরীরের অবয়ব না বুঝা যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤی اَنْ یُّعْرَفْنَ فَلَا یُؤْذَیْنَ ؕ وَ كَانَ اللّٰهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا
হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : ৫৯)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে। (ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪) ইবনে সীরিন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) আবীদা (সালমানী রাহ.)কে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে।
শালীন বোরখা পরিধান করার ব্যাপারে হাদীসে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে অনেক মানুষ বোরখা পরিধান করেন কিন্তু শরীরের অবয়ব আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ফুটে উঠে। হাদীসে এসেছে-
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। দুই শ্রেণীর দোযখী এখনও আমি দেখিনি। (কারণ তারা এখন নেই, ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করবে) এক শ্রেণী হচ্ছে ঐ সকল মানুষ, যাদের হাতে ষাঁড়ের লেজের মতো চাবুক থাকবে, যা দিয়ে তারা মানুষকে প্রহার করবে। (দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে) ঐ সকল নারী, যারা হবে পোশাক পরিহিতা, নগ্ন, আকৃষ্ট ও আকৃষ্টকারী; তাদের মাথা হবে উটের হেলানো কুঁজের ন্যায়। এরা জান্নাতে যাবে না এবং জান্নাতের খুশবুও পাবে না অথচ জান্নাতের খুশবু তো এত এত দূর থেকে পাওয়া যাবে। (মুসলিম: ২১২৮)
৩. নারীগণ পরপুরুষের সামনে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবেনা: বোরখা ছাড়া স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষেত্রে নারীগণ নির্দিষ্ট শ্রেণির পুরুষ ব্যতীত অন্য পুরুষদের সামনে নিজের সৌন্দর্যকে প্রকাশ তথা বোরখা ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ করতে পারবেনা। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলা সুষ্পষ্টভাষায় বলেছেন,
আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাই এর ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের ডান হাত যার মালিক হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (নূর: ৩১)
৪. পর-পুরুষগণ পর নারীদের কাছে কোন জরুরী কাজ থাকলে সেটা পর্দার আড়াল থেকে চাইতে হবে: যতক্ষণ মুখোমুখি হওয়া ছাড়া কাজ সম্পাদন করা সম্ভব ততক্ষণ পর্দার আড়াল থেকেই কাজটি সম্পন্ন করা উচিত। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَ اِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ
তোমরা তাঁদের (নবী পত্নীদের) নিকট কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাও। (আহযাব: ৫৩)
৫. বাহিরে বের হওয়ার সময় নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা আবশ্যক: মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা কিংবা খোলা রাখার ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকলেও বর্তমান ফিতনা-ফাসাদের যুগে আমরা কঠোর মতটিকেই মুসলিম উম্মার জন্য বেশি প্রাধান্য দিব। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
নারীগণ যেন সাধারণত যা প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। (সূরা নূর : ৩১)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, ‘সাধারণত যা প্রকাশিত’ অর্থ হচ্ছে কাপড়। (তাফসীরে তবারী: ১৮/১১৯)
এই ব্যাখ্যা অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, গায়রে মাহরাম তথা পর পুরুষের (যাদের সাথে বিয়ে বৈধ) সামনে নারীর মুখমন্ডলসহ পূর্ণ দেহ আবৃত রাখা অপরিহার্য। কেননা আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন, নিজ স্বামী এবং যাদের সাথে বিয়ে অবৈধ এমন পুরুষ ছাড়া বাকি সকল পুরুষের কাছে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবেনা। অথচ মুখমণ্ডলই তো একজন মানুষের সৌন্দর্যর কেন্দ্রবিন্দু। শুধু তাই নয়, একই আয়াতে আল্লাহ তা’আলা নারীদেরকে আরো কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন,
وَ لَا یَضْرِبْنَ بِاَرْجُلِهِنَّ لِیُعْلَمَ مَا یُخْفِیْنَ مِنْ زِیْنَتِهِنَّ
তারা যেন এমনভাবে পদাচারণা না করে, যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না পেয়ে যায়। (নুরু: ৩১)
রাসূলের যুগে রাসূল সা. এর স্ত্রীগণও সফরে পরপুরুষের সামনে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতেন। হাদীসে এসেছে-
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كُنَّا مَعَ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ وَنَحْنُ مُحْرِمُونَ فَإِذَا لَقِيَنَا الرَّاكِبُ أَسْدَلْنَا ثِيَابَنَا مِنْ فَوْقِ رُءُوسِنَا فَإِذَا جَاوَزَنَا رَفَعْنَاهَا .
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা ইহরাম অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলাম। কোন কাফেলা আমাদের নিকটবর্তী হলে আমরা নিজেদের মাথার সামনে দিয়ে কাপড় ঝুলিয়ে দিতাম তথা মুখমণ্ডল ঢেকে দিতাম। তারা আমাদের অতিক্রম করে যাওয়ার পর আবার তা মুখমণ্ডল থেকে তুলে ফেলতাম। (ইববে মাজাহ: ২৯৩৫)
৬. নারীগণ বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবেনা: আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন,
وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِكُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی
এবং তোমরা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবেনা। (আহযাব:: ৩৩) হাদীসে এসেছে-
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: ” الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتْ، اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ، وَأَقْرَبُ مَا تَكُونُ مِنْ وَجْهِ رَبِّهَا وَهِيَ فِي قَعْرِ بَيْتِهَا “.
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“নারী হলো সতর (আবৃত থাকার বস্ত্ত)। যখন সে ঘর থেকে বের হয়, তখন শয়তান তাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করে। আর সে যখন গৃহাভ্যন্তরে থাকে, তখন সে তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটে অবস্থান করে।” (মু’জামুল আওসত: ৯৯২৪) উপরোক্ত আয়াত ও এই হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নারীদের বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া উচিত নয়।
৭. গাইরে মাহরাম নারী-পুরুষ কাছাকাছি অবস্থান ও মেলামেশা করা যাবেনা: হাদীসে এসেছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ ” . فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَرَأَيْتَ الْحَمْوَ قَالَ ” الْحَمْوُ الْمَوْتُ ”
উকবা ইবনু আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: সাবধান! (গাইরে মাহরাম) মহিলাদের সাথে তোমরা কেউ অবাধে দেখা-সাক্ষাৎ করবে না। আনসার সম্প্রদায়ের এক লোক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দেবর-ভাসুর সম্পর্কে আপনার মত কী? তিনি বললেনঃ সে তো মৃত্যু (সমতুল্য)। (তিরমিজি: ১১৭১) অপর হাদীসে আছে-
أَلَا لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ إِلَّا كَانَ ثَالِثَهُمَا الشَّيْطَانُ
“কোনো পুরুষ যেন কোনো নারীর সাথে একাকী অবস্থান না করে, কারণ তাদের সাথে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে শয়তান উপস্থিত থাকে।” (তিরমিজি: ২১৬৫)
উক্ত হাদীসদ্বয়ে বেগানা নারী-পুরুষের একান্ত অবস্থানকে নিষেধ করা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে স্বামী পক্ষীয় আত্মীয়-স্বজন যেমন দেবর-ভাসুর ইত্যাদির সাথে অধিক সাবধানতা অবলম্বনকে অপরিহার্য করা হয়েছে।
৮. শিক্ষক, পীর কিংবা এমন সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথেও অন্য সাধারণ পুরুষদের ন্যায় পর্দা রক্ষা করা আবশ্যক:
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، قَالَتْ: أَوْمَتْ امْرَأَةٌ مِنْ وَرَاءِ سِتْرٍ بِيَدِهَا، كِتَابٌ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَبَضَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَهُ، فَقَالَ: مَا أَدْرِي أَيَدُ رَجُلٍ، أَمْ يَدُ امْرَأَةٍ؟ قَالَتْ: بَلِ امْرَأَةٌ، قَالَ: لَوْ كُنْتِ امْرَأَةً لَغَيَّرْتِ أَظْفَارَكِ يَعْنِي بِالْحِنَّاءِ.
আয়িশাহ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক মহিলা পর্দার আড়াল থেকে একটি কিতাব হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দিকে বাড়িয়ে দিলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গুটিয়ে নিলেন এবং বললেনঃ আমি বুঝতে পারছি না এটা কোনো পুরুষের হাত না কি নারীর হাত? সে বললো, বরং নারীর হাত। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তুমি মহিলা হলে অবশ্যই তোমার নখগুলো মেহেদীর রঙ দ্বারা রঞ্জিত করতে। (আবু দাউদ: ৪১৬৬)
যাদের সাথে পর্দা নেই তথা বিবাহ নিষিদ্ধ (মাহরাম) নারী পুরুষদের বিবরণ:
মাহরাম পুরুষের সাথে নারীর পর্দা নেই। মাহরাম পুরুষ দ্বারা উদ্দেশ্য হল এমন পুরুষ আত্মীয়, যার সাথে বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে কোনো অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয নয়। যেমন-পিতা, ভাই ইত্যাদি।
আর যে পুরুষের সাথে বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা (যেমন-নারীর বোন বা এমন নারীর বিবাহে থাকা, যাদের দু’জনকে বিবাহসূত্রে একত্র করা জায়েয নয়) দূর হওয়ার পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয সে হল গায়র-মাহরাম। তার সাথে পর্দা করা ফরয।
অপরদিকে একজন পুরুষের মাহরাম নারী হল এমন নারী, যার সাথে তার বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে কোনো অবস্থায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয নয়। যেমন-মা, মেয়ে ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে যে নারীর সাথে তার বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে সাময়িক প্রতিবন্ধকতা (যেমন-নারীর অন্য পুরুষের বিবাহে থাকা) দূর হওয়ার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয সে হল গায়র-মাহরাম।
মাহরাম সম্পর্কের তিনটি ধরন: ১. বংশগত মাহরাম (نسبی محارم) ২. দুধসম্পর্কীয় মাহরাম (رضاعی محارم) ৩. বিবাহসম্পর্কীয় মাহরাম (مصاهرة محارم)
ক. পুরুষের জন্য যেসব নারী মাহরাম তথা যা যেসব নারীর সাথে পুরুষের পর্দা নেই:
১. বংশগত মাহরাম (نسبی محارم) এরা হচ্ছেন রক্তের সম্পর্কীয় মাহরাম
- মা (والدة)
- দাদি ও নানী (মায়ের দিক ও বাবার দিক থেকে) (جدات)
- কন্যা (بنت)
- নাতনি ও পৌত্রী (بنات الأبناء وبنات البنات)
- বোন (أخت)
- ফুফু (পিতার বোন) (عمة)
- খালা (মায়ের বোন) (خالة)
- ভাতিজি (ভাইয়ের কন্যা) (بنت الأخ)
- ভাগ্নি (বোনের কন্যা) (بنت الأخت) (আন-নিসা:২৩)
২. দুধসম্পর্কীয় মাহরাম (رضاعی محارم) যদি কোনো নারী কাউকে দুধ পান করায়, তাহলে দুধমাতা ও দুধভাই-বোন সম্পর্কিত মানুষ মাহরাম হয়ে যায়:
- দুধ-মা (المرضعة)
- দুধ-বোন ও তার অধস্তন মেয়ে, নাতনি… (أخت من الرضاعة)
- দুধভাইয়ের মেয়ে ও তার অধস্তন নাতনি… (أخ من الرضاعة)
- দুধ-মায়ের বোন (খালার মর্যাদায়) ইত্যাদি (বুখারি: ২৬৪৫)
৩. বিবাহসম্পর্কীয় মাহরাম (مصاهرة محارم)
এরা তারা যাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে মাহরামত্ব সৃষ্টি হয়:
- স্ত্রীর মা (শাশুড়ি) (أم الزوجة)
- স্ত্রীর কন্যা (স্ত্রীর পূর্বের স্বামীর কন্যা) (بنت الزوجة)
- ছেলের স্ত্রী (পুত্রবধূ) (زوجة الابن)
- স্ত্রীর বোন (তবে স্ত্রীর সাথে তালাক হলে বা স্ত্রীর মৃত্যু হলে বিয়ে করা বৈধ)
- বাবার স্ত্রী (সৎ মা)
নারীর জন্য যেসব পুরুষ মাহরাম তথা যেসব পুরুষের সাথে নারীর পর্দা নেই:
১. বংশগত মাহরাম (نسبی محارم)
- পিতা (والد)
- পিতার পিতা বা দাদা (جد); যত ওপরেই উঠুক যেমন: দাদার দাদা ইত্যাদি
- মাতার পিতা বা নানা (جد الأم); যত ওপরে উঠুক
- সহোদর ভাই (أخ)
- ভ্রাতুষ্পুত্র ভাইয়ের ছেলে (ابن الأخ) ভাইয়ের নাতি ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত
- বোনের ছেলে বা ভাগ্নে (ابن الأخت) ; বোনের নাতি ও নাতির ছেলে… ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত
- চাচা (عم)
- মামা (خال)
২. দুধসম্পর্কীয় মাহরাম (رضاعی محارم)
- দুধ পিতা: যিনি দুধ পান করিয়েছেন তার স্বামী (أب من الرضاعة) ; ২ বছরের মধ্যে ৫ বার পূর্ণ দুধপান করলে সম্পর্ক হয়
- দুধ-ভাই: দুধপানের মাধ্যমে ভাই (أخ من الرضاعة); দুধ-মা থেকে একই দুধ পানকারী সন্তানরা পরস্পর দুধ ভাই-বোন
- দুধ ভাইয়ের ছেলে: দুধ ভাইয়ের নাতি বা নাতির ছেলে… ইত্যাদিও মাহরামের অন্তর্ভুক্ত
৩. বিবাহসম্পর্কীয় মাহরাম (مصاهرة محارم)
- স্বামী: যতদিন বৈবাহিক সম্পর্ক টিকে থাকে
- শ্বশুর: স্বামীর পিতা (حمو)
- সতীনের ছেলে: স্বামীর অন্য স্ত্রীর সন্তান (ربيب)
সামাজিক অনাচার: বর্তমান অবস্থা ও কারণসমূহ
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় নৈতিকতা ও শালীনতার সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিজ্ঞাপন, বিনোদন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রচারে আজ সমাজে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও অনৈতিকতার বিস্তার ঘটছে। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে, সম্পর্কের পবিত্রতা ভেঙে পড়ছে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা চরম হুমকির মুখে পড়ছে।
১. যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, পরকিয়া অশ্লীলতা ও নৈতিক বিচ্যুতি
- নারীদের প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, পরকিয়া এবং ধর্ষণের ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলেছে।
- অশ্লীল বিজ্ঞাপন, সিনেমা ও সামাজিক মাধ্যমগুলিতে অনবরত অশ্লীলতার প্রসার, বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে মানসিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় সৃষ্টি করছে।
- বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতা পরিবার এবং সমাজের মৌলিক কাঠামোকে দুর্বল করছে।
- অবাধ মেলামেশার ফলে সৃষ্ট হতাশা যুব সমাজকে মাদকাসক্তির প্রতি মারাত্মকভাবে ধাবিত করছে।
২. মিডিয়া ও প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব
- ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি ও বিনোদনমাধ্যম এমন এক সৌন্দর্যের মিথ্যা ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে শরীরের প্রদর্শনকেই সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
- ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অশ্লীলতা ও অনৈতিক কনটেন্টের সহজলভ্যতা নৈতিকতার মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
৩. পর্দাহীনতার কারণে সামাজিক ব্যাধি বিস্তারের উদাহরণ
- নারীর শালীনতা যখন বাহ্যিক আড়াল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন পুরুষের দৃষ্টি অবাধ হয়ে পড়ে এবং সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।
- পর্দাহীনতা এবং অবাধ মেলামেশা যৌন অপরাধ, পারিবারিক ভাঙন এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।
পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়ার কারণসমূহ
- পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ হলো অশ্লীলতার প্রসার এবং যৌন স্বাধীনতার অপব্যবহার।
- সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা না থাকা এবং সামাজিক অবক্ষয় পরিবারের অভ্যন্তরে বিরোধ, বিচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়।
সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে পর্দার ভূমিকা
ইসলামে পর্দা শুধু একটি ধর্মীয় বিধান নয়; এটি সামাজিক শুদ্ধি ও নৈতিকতার রক্ষাকবচ। ব্যক্তিগত সংযম এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পর্দা এক অব্যর্থ মাধ্যম। যখন পর্দা সঠিকভাবে পালন করা হয়, তখন তা সামাজিক অনাচার ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।
১. শালীনতা ও নৈতিকতা রক্ষা
- পর্দা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে শালীনতার সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
- দৃষ্টির সংযম এবং শরীরের আবরণ অনৈতিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা সমাজে বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- ইসলামী সমাজে পর্দা শুধু নারীর জন্য নয়, বরং পুরুষদের জন্যও দৃষ্টি ও আচরণের শুদ্ধতার প্রতীক।
২. পারস্পরিক সম্মান ও সীমা নির্ধারণ
- পর্দা নারী ও পুরুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার অনুভূতি জাগ্রত করে।
- সীমাবদ্ধ আচরণ ও সংযত মেলামেশার ফলে অবৈধ সম্পর্ক এবং যৌন হয়রানির সুযোগ কমে যায়।
- মানুষ একে অপরকে শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে না বিচার করে, বরং চরিত্র ও মেধার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে শেখে।
৩. নারী-পুরুষের সম্পর্কের পবিত্রতা সংরক্ষণ
- পর্দার মাধ্যমে নারী-পুরুষের সম্পর্ক পবিত্র এবং ন্যায়নিষ্ঠ হয়।
- অবৈধ আকর্ষণ, প্রেমের ফাঁদ ও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
- বৈধ সম্পর্ক (বিবাহ) ও পারিবারিক বন্ধন মজবুত হয়, যা একটি নৈতিক সমাজ গঠনে সহায়ক।
৪. সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার বৃদ্ধি
- যখন নারী-পুরুষ উভয়ই পর্দার নীতিমালা অনুসরণ করে, তখন সমাজে নিরাপত্তা ও আস্থা বৃদ্ধি পায়।
- ইভটিজিং, পরকিয়া, ধর্ষণ ইত্যাদি যাবতীয় যৌন অপরাধের হার হ্রাস পায়, এবং নারী সমাজে নিরাপদে চলাচল করতে সক্ষম হয়।
- পরিবারের ভিত্তি শক্তিশালী হয় এবং শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও নৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত হয়।
আধুনিক সমাজে পর্দার চ্যালেঞ্জ ও প্রতিক্রিয়া
ক. চ্যালেঞ্জসমূহ
আজকের তথাকথিত আধুনিক বিশ্বে পর্দা একটি বহুল আলোচিত এবং অনেকক্ষেত্রে বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে পর্দা চর্চা নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে কিছু বাহ্যিক, কিছু অভ্যন্তরীণ। কিছু চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করা হলো-
১. পর্দা নিয়ে ভুল ধারণা ও অপপ্রচার
- পাশ্চাত্য মিডিয়া ও কিছু সেক্যুলার চক্র পর্দাকে নারীর নির্যাতন ও পশ্চাৎপদতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করছে।
- হিজাব পরা নারীদের “অসহায়”, “অমুক্ত” কিংবা “মধ্যযুগীয়” ভাবা হয়।
- এইসব ভুল ধারণা অনেক তরুণীকে বিভ্রান্ত করে এবং ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে।
২. ধর্মীয় স্বাধীনতা ও পোষাকের অধিকার থেকে বঞ্চিতকরণ
- বহু দেশে হিজাব ও নিকাব নিষিদ্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নারীর ধর্মীয় স্বাধীনতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
- একজন নারী যদি নিজের ইচ্ছায়, বিশ্বাসের কারণে পর্দা পালন করেন, তবে তা তার মৌলিক অধিকার—যা পশ্চিমাদের তথাকাথিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিতেও স্বীকৃত।
- পর্দার বিরুদ্ধে আইন ও সামাজিক চাপ নারীদের মৌলিক বিশ্বাসকে আঘাত করে এবং বৈষম্য তৈরি করে।
খ. প্রতিক্রিয়াসমূহ:
উপরোক্ত চ্যালেঞ্জসমূহের বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের নারীগণ তাদের ঈমান, কর্ম ও দক্ষতা দিয়ে তথাকথিত আধুনিক বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে যে, মুসলিম নারীগণ তাদের সম্মানের প্রতিক পর্দা লঙ্ঘন না করেও সর্বক্ষেত্রে তারা শীর্ষে অবস্থান করছে; কোন ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে নেই। নিচে কিছু প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করা হলো।
- আধুনিক যুগের অনেক মুসলিম নারী প্রমাণ করেছেন যে পর্দা কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, এটি আত্মসম্মান, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীনতার প্রতীক।
- শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক—অনেক নারী হিজাব পরে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সফলতার উদাহরণ স্থাপন করছেন।
- পর্দা এখনো এক শ্রেষ্ঠ আত্মপরিচয়ের প্রতীক, যা নারীদের নিজস্ব মর্যাদা বজায় রাখার সুযোগ দেয়।
৮. উপসংহার:
পর্দা কোনো নির্দিষ্ট সময় বা সংস্কৃতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানব সভ্যতার শুদ্ধতা, নিরাপত্তা ও নৈতিক উন্নতির একটি চিরন্তন বিধান। ইসলাম পর্দাকে মানুষের সম্মান, মর্যাদা এবং নৈতিকতার রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটি কেবল বাহ্যিক আচ্ছাদন নয়, বরং দৃষ্টির সংযম, আচরণের শালীনতা এবং চিন্তার পবিত্রতার এক সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা।
বর্তমান বিশ্বের নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অনাচার এবং পারিবারিক ভাঙনের পটভূমিতে পর্দার প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আধুনিকতা ও স্বাধীনতার নামে যে অনাচার ও বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে, তা রোধ করতে হলে আমাদের আবারও শালীনতা, সম্মান এবং আত্মসংযমের নীতিতে ফিরে যেতে হবে।
পর্দা কেবল নারী নয়, সমগ্র সমাজের নৈতিক পুনর্জাগরণের এক অপরিহার্য মাধ্যম। ব্যক্তি থেকে সমাজ, পরিবার থেকে রাষ্ট্র—সব স্তরে শুদ্ধ ও স্থিতিশীল জীবন গড়তে পর্দার শিক্ষা ও চর্চা নতুন আশার দীপ্তি ছড়াতে পারে। তাই, সামাজিক অনাচার রোধ এবং মানব মর্যাদার সংরক্ষণে পর্দার গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই।
উপরোক্ত বয়ানের আরবী অনুবাদ (সংক্ষিপ্ত ও মূলবক্তব্য)
اَلْحَمْدُ لِلَّهِ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ، أَمَّا بُعْدُ . . . . . . . . . . . . . . .
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامَ –
مَوْضُوعُنَا الْيَوْم: أَهَمِّيَّةُ الْحِجَابِ فِي مَنْعِ الجَرِيْمَةِ الِاجْتِمَاعِيِّةِ وَأَحْكَامُ الْحِجَابِ.
أَيُّهَا الْحَاضِرُونَ الكِرَامَ ، أُلْقِي أَمَامَكُمْ الآنَ بَعْضَ أَحْكَامِ الْحِجَابِ.
أَوَّلًا: يَغُضُّ كُلٌّ مِنَ الرَّجُلِ وَالْمَرْأَةِ نَظَرَهُ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فِي القُرآنِ: قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ ؕ ذٰلِكَ اَزۡكٰی لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ خَبِیۡرٌۢ بِمَا یَصۡنَعُوۡنَ- وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ. كَمَا جَاءَ فِي الحَدِيْثِ: إِنَّ النَّظْرَةَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ إِبْلِيسَ مَسْمُومٌ.
ثَانِيًا: عَلَى النِّسَاءِ أَنْ تَرْتَدِيَ الْحِجَابَ الْمُحْتَشِمَ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فِي القُرآنِ: یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ؕ ذٰلِكَ اَدْنٰۤی اَنْ یُّعْرَفْنَ فَلَا یُؤْذَیْنَ ؕ وَ كَانَ اللّٰهُ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا. كَمَا جَاءَ فِي الحَدِيْثِ: عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلاَتٌ مَائِلاَتٌ رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ لاَ يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ وَلاَ يَجِدْنَ رِيحَهَا وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا ”
ثَالِثًا: لَا يَنْبَغِي لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَكْشِفَ جَمَالَهَا أَمَامَ الرِّجَالِ غَيْرِ المَحَارِمِ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فِي القُرآنِ: وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِهِنَّ ۪ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا لِبُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اٰبَآئِهِنَّ اَوۡ اٰبَآءِ بُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اَبۡنَآئِهِنَّ اَوۡ اَبۡنَآءِ بُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اِخۡوَانِهِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اِخۡوَانِهِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اَخَوٰتِهِنَّ اَوۡ نِسَآئِهِنَّ اَوۡ مَا مَلَكَتۡ اَیۡمَانُهُنَّ اَوِ التّٰبِعِیۡنَ غَیۡرِ اُولِی الۡاِرۡبَۃِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفۡلِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یَظۡهَرُوۡا عَلٰی عَوۡرٰتِ النِّسَآءِ.
رَابِعًا: إِذَا كَانَ هُنَاكَ عَمَلٌ عَاجِلٌ لِلرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ فَعَلَيْهِمْ أَنْ يَطْلُبُوهُ مِنْ وَرَاءِ السِّتَارِ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فِي القُرآنِ: وَ اِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ.
خَامِسًا: لَا يَجُوزُ لِلْمَرْأَةِ أَنْ تَخْرُجَ مِنْ الْمَنْزِلِ إِلَّا لِلضَّرُورَةِ: كَمَا قَالَ اللهُ تَعَالَى فِي القُرآنِ: وَ قَرۡنَ فِیۡ بُیُوۡتِكُنَّ وَ لَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ الۡجَاهِلِیَّۃِ الۡاُوۡلٰی. كَمَا جَاءَ فِي الحَدِيْثِ: عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: ” الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتْ، اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ، وَأَقْرَبُ مَا تَكُونُ مِنْ وَجْهِ رَبِّهَا وَهِيَ فِي قَعْرِ بَيْتِهَا “.
بَارَكَ اللَّهُ لِي وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيمِ، وَنَفَعَنِي وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيهِ مِنَ الْايَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيمِ. أَقُولُ قَوْلِي هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الْجَلِيل، لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِينَ مِنْ كُلِّ ذَنْبٍ فَاسْتَغْفِرُوه أَنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
সংকলন ,সম্পাদনা, পরিমার্জন ও আরবী তরজমা: ইমরান মাহমুদ (পিএইচডি গবেষক, আরবী বিভাগ, ঢাবি) পুনর্মূল্যায়ন: মুফতি ইসমাঈল হোসাইন (খতিব ও দাঈ)