বিবাহের মৌলিক রীতি- নীতি: শরীয়া ও প্রচলিত আইনের দৃষ্টিকোন

প্রস্তুতকারী: ‏আফরোজা সুলতানা (Department of LAW, DU)

সম্পাদনা: সানজিদা মুক্তা (Department of LAW ,DU)

বিবাহকে আরবী পরিভাষায় বলা হয় নিকাহ।

‘নিকাহ’র আক্ষরিক অর্থ একত্রে অংশগ্রহণ (joining together)

মুসলিম আইনে এটি মানে বিয়ে।  কুরআনে ‘নিকাহ’কে ‘হিসান’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটি একটি দুর্গ – যার অর্থ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে সামাজিক, শারীরিক এবং নৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। নিকাহ’ শুধুমাত্র যৌন উপভোগের জন্য নয়, এর মূল লক্ষ্য হলো ‘সুকুন অর্থাৎ তৃপ্তি বা আরাম বা মনের শান্তি, প্রেম-‘মুআদ্দাত’ এবং রহমত বা দয়া বা সহানুভূতি অর্জন।

⚫ বিবাহের তিনটি দিক রয়েছে :

 ১. আইনগত

 ২. সামাজিক এবং

 ৩. ধর্মীয়

১.আইনগত দিক থেকে এটি যৌন মিলন, প্রজনন বৈধ করেছে এবং সন্তানের বৈধতা দান করেছে।

২.সামাজিক দিক থেকে এটি নারীদের উচ্চতর অবস্থান দিয়েছে।

৩.ধর্মীয় দিক থেকে এটি মানুষকে উন্নতির দিকে পরিচালিত করে এবং  মানব জাতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

ইসলামে বিবাহ একটি চুক্তি।  “আব্দুল কাদির বনাম সালিমা (১৮৮৬) ” বিখ্যাত এই মামলায় বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ বলেছেন:

 “মুসলমানদের মধ্যে বিবাহ একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নয়, মূলত এটি একটি চুক্তি।”

⚫ একটি বৈধ মুসলিম বিবাহের অপরিহার্য শর্তাবলী:

 ১. ইজাব বা প্রস্তাব – এক পক্ষ কর্তৃক অপর পক্ষকে প্রস্তাব।

 ২. অন্যের পক্ষ থেকে গ্রহণ বা কবুল বা নাবালক হলে অভিভাবকরা মেনে নেবেন।  কনের সম্মতি অপরিহার্য।৩. উপযুক্ত সাক্ষীর সামনে- দুইজন মুসলিম পুরুষ বা একজন মুসলিম পুরুষ এবং দুইজন মুসলিম নারী।  সাক্ষীকে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম হতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র নারীরা সাক্ষী হতে পারে না।

 ৪. বিবাহের খুতবায় পঠিত শব্দগুলি অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ও  সুনিশ্চিতভাবে  এটা নির্দেশ করবে যে একটি বিবাহ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতের কোনো তারিখে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি এমন  কোনো নিছক কথা বলা হলে বিবাহ হবে না।

 ৫. প্রস্তাব (ইজাব)এবং গ্রহণ (কবুল)  উভয়ই এক বৈঠকে প্রকাশ করতে হবে।

 ৬. বর-কনে পক্ষকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে । তবে যদি পাগল বা উন্মাদ হয় তাহলে তাদের অভিভাবকদের দ্বারা বিয়ে করা যেতে পারে।

 ৭. উভয় পক্ষ অবশ্যই বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত হতে হবে। (হেদায়ার মতে :

মেয়েরা ৯ বছর বয়সে বয়ঃসন্ধি বা পরিপক্কতায় পৌঁছায়  এবং ছেলেরা ১২ বছর বয়সে পৌঁছায়।

 “The  Majority Act 1875” অনুযায়ী “ একজন ব্যক্তি ১৮ বছর বয়সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয় অন্যথায় তারা তাদের অভিভাবকদের দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করবে।

বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, ১৯২৯-এ

বিয়ের বয়স মেয়েদের ১৪ এবং ছেলেদের ১৮।

 মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ অনুযায়ী মেয়েদের জন্য বিবাহযোগ্য বয়স ১৬ এবং ছেলেদের  জন্য ১৮।

বিবাহ নিরোধ (সংশোধন) আইন, ১৯৮৪

অনুযায়ী মেয়েদের জন্য বিবাহযোগ্য বয়স ১৮ এবং ছেলেদের জন্য ২১।

৮. বিবাহের ক্ষেত্রে অবশ্যই মোহরানা থাকবে। নির্ধারিত বা যথাযথ মোহর অবশ্যই থাকতে হবে।

 ৯. পুরুষদের মুসলিম হওয়া আবশ্যক কিংবা নারীদের ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন মুসলিম বা কিতাবিয়া হতে হবে। আগুন/মূর্তি পূজারী নয়।

 ১০. কোন আইনগত অক্ষমতা বা বাধা থাকতে হবে না। যেমন  যদি তারা নিষিদ্ধ ডিগ্রী মধ্যে সম্পর্কিত হয় তারা বিয়ে করতে পারবে না। ( মাহরাম নারী-পুরুষ)

 ১১.আচার অনুষ্ঠানের কোন প্রয়োজন নেই, যেমন  হিন্দু আইন সপ্তপদী এবং লাজোহোমা অপরিহার্য, কিন্তু মুসলিম বিবাহ একটি চুক্তি।

⚫ বিবাহ নিবন্ধন:

The Muslim Marriages and Divorces ( Registration) Act,1974 এর ৩ ধারার অধীনে বাংলাদেশে প্রত্যেক মুসলিম বিবাহের রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। তবে বিয়ে বৈধ  হওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশনের কোনো প্রয়োজন নেই কারণ এটি কুরআনে বা হাদীসে বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

অন্যদিকে নিবন্ধনের বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞামূলক বিধানও নেই।

সুতরাং বিবাহ নিবন্ধন একটি বৈধ বিবাহের জন্যে প্রয়োজন নয় কিন্তু বিভিন্ন ধরণের সুরক্ষার জন্য একটি আইনি সীমাবদ্ধতা প্রদান করে যেমন বিবাহ অস্বীকার প্রতিরোধ, পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নারী ও শিশুদের জন্য উত্তরাধিকার অধিকার মজবুত করে, যেন একজন মানুষ পরবর্তীতে এই বিয়ে অস্বীকার করতে না পারে।

⚫বিবাহের প্রকারভেদ:

বিবাহ তিন রকমের হতে পারে।

১. বৈধ বিবাহ।

২. অনিয়মিত বিবাহ।

৩.  বাতিল বিবাহ।

১. বৈধ বিবাহ:

মুসলিম আইনের সকল নিয়ম মেনে যে বিবাহ সম্পাদন হয় সেটা বৈধ বিবাহ।

একটি বৈধ বিবাহের আইনগত ফলাফল হল:

 (ক) যৌন মিলন হালাল হয়ে ওঠে এবং এই বন্ধনে থাকা অবস্থায় সন্তান জন্মদান বৈধ।

 (খ) স্ত্রী মোহরানা বা ‘ দেনমোহর’ পাওয়ার অধিকারী হয়।

 (গ) স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হয়।

 (ঘ) তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর মাধ্যমে বিয়ে ভেঙে গেলেও স্ত্রী পুনরায় ইদ্দত পালন না করে বিয়ে করার অধিকারী নয়৷ (ঙ) একজন মহিলা বিবাহ দ্বারা তার অবস্থা পরিবর্তন করে না; তাই বিয়ের পর নাম পরিবর্তনও ইসলামিক নয়।

(চ)পারস্পরিক উত্তরাধিকারের  অধিকার,

 (ছ) স্বামীর যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতিতে তার স্ত্রীর চলাফেরা নিয়ন্ত্রন করার অধিকার রয়েছে  ।

২. অনিয়মিত বিবাহ:

যে বিয়ে অস্থায়ী কারণে অবৈধ কিন্তু পরবর্তীতে বৈধ হতে পারে। যেমন:

(ক) সাক্ষী ব্যতীত বিয়ে করলে

(খ) ইদ্দত পালনকারী কোনো মহিলাকে বিয়ে করলে।

(গ) ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে নিষিদ্ধ বিয়ে করলে।

(ঘ) ইদ্দত পালনকারী কোন মহিলার সাথে বিবাহ।

(ঙ) চতুর্থ স্ত্রী বর্তমান থাকাকালীন পঞ্চম বিবাহ করলে।

(চ) কোন ব্যাক্তি কর্তৃক একসাথে দুই আপন বোনকে বিয়ে করা।

⚫ অনিয়মিত বিবাহের ফলাফল:

ক. অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন না হলে স্ত্রী কোনো দেনমোহর পাবেনা। শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন হলে যথাযথ দেনমোহর পাবে। যদি দেনমোহরের পরিমাণ নির্ধারিত থাকে তাহলে নির্ধারিত দেনমোহর (মোহর-আল- মুসাম্মা) এবং যথাযথ দেনমোহর (মোহর- আল-মিছিল) এর মধ্যে যেটা কম সেটা পাবে।

খ. অনিয়মিত বিবাহের মাধ্যমে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন হোক বা না হোক, স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে উত্তরাধিকারের পারস্পরিক কোন অধিকার সৃষ্টি করেনা।

গ. অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে বৈধ হবে এবং বৈধ সন্তানের মত উত্তরাধিকারসহ অন্যান্য অধিকার ভোগ করবে।

ঘ. স্ত্রীকে ইদ্দত পালন করতে হবে যদি শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন হয়ে থাকে।

 ৩.  বাতিল বিবাহ: বাতিল বিবাহ হল একটি বিবাহ যা বিভিন্ন কারণে শুরু থেকেই নিষিদ্ধ।

যেমন:

 ক. নিষিদ্ধ ডিগ্রির মধ্যে মহিলার সাথে বিবাহ।

 খ. একজন মুসলিম মহিলার সাথে একজন কাফের বা অমুসলিমের বিয়ে।

 গ. অন্যের স্ত্রী জেনে একজন মহিলার সাথে বিয়ে করা।

 ঘ. পুরুষকে চাপের মধ্যে রেখে বিবাহ চুক্তিবদ্ধ করা।

🚫 বাতিল বিবাহের আইনগত প্রভাব:

 ১.  এটি একটি অবৈধ বিবাহ।

 ২. আইনের চোখে এটি কোন বিবাহ নয় এবংএরআইনগতফলাফলনেই

 ৩. এটি পক্ষগুলির মধ্যে পারস্পরিক অধিকার এবং দায়বদ্ধতা তৈরি করে না।

৪. এই বিবাহের ফলে জন্মগ্রহণ করা সন্তান অবৈধ।

৫. বাতিল বিবাহের ক্ষেত্রে কারণগুলো স্থায়ী প্রকৃতির এবং এমন কারণ অপসারিত করে  বিবাহ বৈধ করার সুযোগ নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More To Explore

Scroll to Top